বঙ্গরাজনীতির কারবারিদের এখন পাখির চোখ চব্বিশের লোকসভা ভোট। তাই শাসক থেকে বিরোধী –সব দলের সামনে একটাই লক্ষ্য ভোট বৈতরণি পার হওয়া। তাই ভোটের পালে হাওয়া দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে তৃণমূল। সেইমতো বিরোধীজোটের শরিক তৃণমূল রাজ্য ছেড়ে দিল্লিতে গিয়ে কেন্দ্রের বঞ্চনা নিয়ে সরব হয়েছে। তাতে গোচোনা ঢেলে দিতে চাইছে গেরুয়া শিবির। তাদের হাতিয়ার তৃণমূলের ‘দুর্নীতি’।
ইতিমধ্যে শিক্ষা থেকে গ্রামোন্নয়ন–রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দফতরের দুর্নীতি নিয়ে মামলায় জেরবার বঙ্গের শাসকদল। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার হাতে গ্রেফতার হয়ে রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী থেকে আমলা–অনেকেই বিচারাধীন বন্দি। যদিও কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার তদন্তে খুশি হতে পারছে না আদালত। ভরা এজলাসে তদন্তকারী আধিকারিকদের আদালতের ভর্ৎসনার মুখে পড়তে হচ্ছে। এই আবহে ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণার আগেই রঙ্গ দেখেছে বঙ্গবাসী।
দিনটি ছিল গান্ধীজয়ন্তী। বঙ্গের তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা একাধিক ভলবো বাসে চেপে রাজঘাটে গিয়ে ধরনায় বসলেন। নেতৃত্বে দলের সেনেন্ড-ইন-কম্যান্ড অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখান থেকে পুলিশের তাড়া খেয়ে পরদিন কৃষিভবনে ধরনা। সেখানেও হোঁচট খেতে হল আন্দোলনকারীদের। কেন্দ্রের বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গেলে ফের পুলিশ বিক্ষোভকারীদের টেনে হিঁচড়ে কৃষিভবন থেকে বের করে মুখার্জিনগর থানায় নিয়ে গিয়ে আটকে রাখে। নিচুতলার তৃণমূলকর্মীরা প্রতিবাদী হয়ে বিক্ষোভ দেখালে পুলিশ তাঁদের তাড়া করে। টিভির পর্দায় বঙ্গবাসী দেখল ঠিক যেভাবে বিরোধীদের নবান্ন অভিযান করতে গেলে শাসকের বাধার মুখে পড়তে হয়, সেভাবেই দিল্লি পুলিশের হাতে তৃণমূল নেতাকর্মীদের হেনস্তা হতে হল।
তবুও কেন্দ্রীয় বঞ্চনা নিয়ে পঞ্চাশ লক্ষ চিঠির বান্ডিল নিয়ে সদলবলে দিল্লির রাজপথে হাঁটলেন অভিষেক। কলকাতার মেয়র থেকে মন্ত্রী-সাংসদরা দলের নেত্রীর দেখানো পথে বিরোধীদলের ভূমিকা পালন করলেন ঠিকই, তবে ভোটারদের কতটা মন কাড়তে পারলেন তা অবশ্য সময় বলবে। তার আগে কেন্দ্রের কাছে রাজ্যের বকেয়া আদায়কে হাতিয়ার করে যন্তর মন্তরের সমাবেশে হুঙ্কার ছেড়েছেন অভিষেক। তিনি বলেন– আন্দোলনের শুরু। কেন্দ্রের কাছ থেকে আমরা সুদ সমেত টাকা ফেরত নেব। পাল্টা বঙ্গে ১০০ দিনের কাজের টাকা ঘিরে ব্যাপক বেনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারি। বিষয়টি নিয়ে সিবিআই তদন্তের দাবি তুলেছেন তিনি। মঙ্গলবার দিল্লিতে কৃষি ভবনে গিয়ে কেন্দ্রীয় পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী সাধ্বী নিরঞ্জন জ্যোতির সঙ্গে দেখা করেন শুভেন্দু। কিন্তু তৃণমূলের নেতানেত্রীদের সকলের সঙ্গে কেন্দ্রীয়মন্ত্রী দেখা করতে রাজি হননি বলে অভিযোগ। প্রতিবাদে কৃষি ভবনে অভিষেকের নেতৃত্বে ধরনায় বসেন তৃণমূলের প্রতিনিধি দলের নেতানেত্রীরা। পুলিশ তাঁদের আটক করে থানায় নিয়ে যায়।
ঘটনায় তৃণমূল-সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া– বাংলার জনগণের প্রতি বিজেপির ঘৃণা, দরিদ্রদের অধিকারের প্রতি তাদের অবজ্ঞা প্রকাশ পেয়েছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেছেন– প্রথমত, তারা বাংলার দরিদ্রদের জন্য বরাদ্দ গুরুত্বপূর্ণ তহবিল আটকে রেখেছে। আমাদের প্রতিনিধি দল যখন দিল্লিতে শান্তিপূর্ণ ভাবে প্রতিবাদ করতে এবং জনগণের দুর্দশার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তখন তাদের সঙ্গে নির্মম ব্যবহার করা হয়েছে। প্রথমে রাজঘাটে এবং তার পরে কৃষি ভবনে। বিজেপির হাত হিসাবে কাজ করা দিল্লি-পুলিশ আমাদের প্রতিনিধিদের নির্লজ্জ ভাবে হেনস্তা করেছে। যাঁদেরকে জোর করে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁদের অপরাধীদের মতো পুলিশ ভ্যানে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কারণ, তাঁরা ক্ষমতার সামনে সত্য কথা বলার সাহস দেখিয়েছিলেন। তাদের ঔদ্ধত্যের কোনও সীমা নেই। অহঙ্কার তাদের অন্ধ করে দিয়েছে। বাংলার কণ্ঠস্বরকে দমন করতে তারা এখন সব সীমা অতিক্রম করেছে! এ নিয়ে মমতা সমাজমাধ্যমে লিখেছেন, “কিন্তু আমরা ভয় করব না ভয় করব না, দু’বেলা মরার আগে মরব না, ভাই, মরব না।”
তাই এ বার রাজভবন অভিযানের ডাক দিয়েছেন অভিষেক। আর কেন্দ্রীয়মন্ত্রী সাধ্বী নিরঞ্জনের দাবি, ‘‘বারবার দুর্নীতির অভিযোগে রিপোর্ট তলব করেও জবাব মেলেনি।’’ তাঁর আরও দাবি– দুর্নীতিতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ না করার জন্যই টাকা আটকানো হয়েছে। একই সুরে গ্রামোন্নয়নমন্ত্রী গিরিরাজ সিং বলেছেন–পশ্চিমবঙ্গকে ২ লক্ষ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। শুধু এমজিএনআরইজিএ প্রকল্পতেই ৫৪ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ দুর্নীতির আখড়া হয়েছে। এই লুঠ লুকোতেই অরাজকতা চলছে। এমনকী কেন্দ্রীয়মন্ত্রী ‘দুর্নীতি’ নিয়ে সিবিআই তদন্তের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। এ ভাবেই ভোটের ঘণ্টা বাজার আগেই শাসক-বিরোধী তরজা দেখছে বঙ্গবাসী।