পশ্চিম বঙ্গ দিবস পালন এবং রাজনীতি

কেরালার রাজভবনে উদযাপিত হচ্ছে ‘পশ্চিম বঙ্গ দিবস’। -নিজস্ব চিত্র

দ্বিখণ্ডিত দুই বঙ্গ। তাই ‘পশ্চিম বঙ্গ’ গঠন নিয়ে বিতর্ক উসকে দিলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই রাজভবনের ডাককে ফিরিয়ে দিলেন তিনি। তাঁর এ হেন সিদ্ধান্তে অবশ্য কান পাতল না রাজভবন। তাই যথারীতি এ বছরেও সেখানে পালিত হল পশ্চিম বঙ্গ দিবস। ২০ জুন, এ দিন শুধু এ রাজ্যে-ই নয়,  কেরালার রাজভবনেও দিনটি পালিত হল। বঙ্গভঙ্গের দুঃখ ভুলে আনন্দময় পরিবেশে-ই দিনটি উদযাপিত হয়।

    যদিও পশ্চিম বঙ্গ দিবস পালনকে বিজেপির কর্মকাণ্ড বলেই মনে করছেন বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। যেহেতু এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নাম, বিজেপি যাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত। বিজেপি-র দাবি, শ্যামাপ্রসাদের নেতৃত্বেই ১৯৪৭ সালের ২০ জুন আনুষ্ঠানিক ভাবে ভারতের অংশ হিসাবে পশ্চিম বঙ্গে সিলমোহর পড়ে। সে দিন শ্যামাপ্রসাদপন্থী ৫৪ জন বিধায়কের প্রবল দাবির কাছেই পশ্চিম বঙ্গ স্বীকৃতি পেয়েছিল। শ্যামাপ্রসাদের দাবি ছিল, ভারত ভাগ করলে বাংলাকেও ভাগ করতে হবে। বাংলার হিন্দুপ্রধান অঞ্চলগুলি নিয়ে ‘পশ্চিম বঙ্গ’ গঠন করতে হবে। যা হবে হিন্দুপ্রধান ভারতের অংশ। এ নিয়ে প্রচার করার জন্য শ্যামাপ্রসাদ সারা বাংলা চষে বেড়ান এবং কংগ্রেসের সমর্থন পান বলেও দাবি বিজেপি-র। যার ফলশ্রুতিতে পশ্চিম বঙ্গের জন্ম। এই দিনটি প্রতি বছর নিয়মিত পালন করে গেরুয়া শিবির। পাশাপাশি রাজভবনও দিনটি উদযাপন করে। এ বছরেও তার অন্যথা না হওয়ায় ক্ষুব্ধ বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী।

    মমতা রাজ্যপালকে লিখেছেন, ‘‘স্বাধীনতার পর থেকে কখনও বাংলায় পশ্চিম বঙ্গ দিবসের মতো কোনও অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়নি। দেশ বিভাজনের এই ঘটনাকে বাংলা সদাই মনে রেখেছে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান হিসেবে।’’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘‘পশ্চিম বঙ্গের জন্ম কোনও বিশেষ দিনে হয়নি। আমরা বাংলায় জন্মেছি, বড় হয়েছি। কখনও এখানে কোনওদিন পশ্চিম বঙ্গ দিবসের মতো কোনও অনুষ্ঠান হতে দেখিনি। এই ধরনের অনুষ্ঠান কোনও রাজনৈতিক দল নিজেদের প্রতিহিংসার রাজনীতির জন্য করতেই পারে, কিন্তু এই ধরনের কোনও অনুষ্ঠানের সঙ্গে সরকারের কোনও যোগাযোগ নেই।’’

  পশ্চিমবঙ্গ দিবসে লোকশিল্পীদের সঙ্গে রাজ্যপাল আরিফ মহম্মদ খান। –নিজস্ব চিত্র

    মমতার কথায়, ‘‘বাংলার কৃষ্টি ও সংস্কৃতি অত্যন্ত উচ্চমানের, যা নিয়ে অনেক দিনের ইতিহাস রয়েছে। বাংলা থেকে স্বাধীনতার আন্দোলন হয়েছে, রেনেসাঁস হয়েছে, হয়েছে সমাজ সংস্কার। তাই রাজভবনে এমন কিছু অনুষ্ঠিত হলে মানুষের মধ্যে সংশয়, অবিশ্বাস ও রাজনৈতিক বিরূপতা তৈরি করতে পারে।’’ কিন্তু বিজেপির বঙ্গ বিগ্রেডের রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের দাবি, ‘‘২০ তারিখেই তো পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন যে প্রাদেশিক আইনসভা ছিল, সেই আইনসভাতেই তো এই আইন পাস হয় যে,  বঙ্গ দু’ভাগে ভাগ হবে এবং পশ্চিম বঙ্গ বলে একটি রাজ্য গঠিত হবে। এটা ইতিহাস। অস্বীকার করার জায়গা নেই।’’ এই ইতিহাসকে মান্যতা দিয়ে পশ্চিম বঙ্গের পাশাপাশি কেরালাতেও এ দিন পালিত হল ‘পশ্চিম বঙ্গ  দিবস’। রাজভবনের ডাকে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে অংশ নেয় তিরুবনন্তপুরমের বাঙালি অ্যাসোসিয়েশন। নাচে-গানে-কবিতায় তাদের তরফে তুলে ধরা হয় বৈচিত্রের মধ্যে একতার সুর। আর রাজ্যপাল আরিফ মহম্মদ খানের কথায়–আমরা ভারতীয়। আমাদের আত্মা এক।

    আসলে প্রতিটি রাজ্যের প্রতিষ্ঠাকে চিহ্নিত করার মধ্যে দিয়ে দেশের সংহতিকে শক্তিশালী করতে চায় কেন্দ্র। তার মধ্যে রাজনীতির গন্ধ পাচ্ছেন বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। তাই এ দিন তিনি রাজভবনে পশ্চিম বঙ্গ দিবস পালনের অনুষ্ঠান বয়কট করলেন। এই সিদ্ধান্তের জন্য বঙ্গবাসী তাঁকে কত নম্বর দেবেন, সেই বিতর্কে না গিয়ে বলা যেতেই পারে ‘পশ্চিম বঙ্গ দিবস’ যথেষ্ট তাৎপর্য বহন করে। এই দিনটি পালনের মধ্যে দিয়ে উঠে আসে রাজ্যের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং সামাজিক-রাজনৈতিক অবদান। এটি পশ্চিম বঙ্গের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও অর্জনের অনুস্মারক হিসেবে কাজ করে, ঐক্য, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য সম্মিলিত দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার করে। তাই রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে কেরালার বাঙালি সমাজের বার্তা–বসুধৈব কুটুম্বকম্।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here