লজ্জাহীন লজ্জা!

প্রতীকী ছবি–সংগৃহীত

দু’দশক আগে সেনারা যা করেছিল তার জন্য সাধারণ মানুষ তীব্র ধিক্কারে পথে নেমে এসেছিল। আর আজ? মণিপুরে ন্যক্কারজনক ঘটনার প্রেক্ষিতে

লিখছেন সফিউন্নিসা

নে পড়ে মনোরমা থংযামকে? মণিপুরের শিক্ষিত সেই মেয়েটি যাকে সেনাবাহিনীর কয়েকজন গণধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি, প্রতিক্রিয়ায় তাদের মুখে থুতু ছেটানোর ‘অপরাধে’ তাঁর গোপনাঙ্গে কয়েকটি বুলেট ফুঁড়ে দিয়েছিল। তার প্রতিবাদে পরের দিন মেয়েরা-মায়েরা নেমে এসেছিল রাজপথে; বিবস্ত্র হাজার নারী মৌন মিছিল করে সেনাবাহিনীর হেড কোয়ার্টার ঘেরাও করেছিল। তাদের প্রত্যেকের হাতে প্লাকার্ড, তাতে লেখা –‘ভারতীয় সেনা! এসো, আমাদের ধর্ষণ করো।’

      সারা দেশ জুড়ে তীব্র চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল সেই ঘটনা। দু’দশক পরে আজ সেই মণিপুরেই সদ্য ঘটে যাওয়া চরম ন্যক্কারজনক ঘটনার প্রেক্ষিতে সেখানকার দীর্ঘ আন্দোলনে-অনশনে সামিল হওয়া ভূমিকন্যা শর্মিলা ইরম চানু বলেছেন– তিনি আর ফিরতে চাননা তাঁর জন্মভূমিতে। কেননা এই জন্মভূমিকে তিনি চিনতে পারছেন না।

     দু’দশক আগে সেনারা যা করেছিল তার জন্য সাধারণ মানুষ তীব্র ধিক্কারে পথে নেমে এসেছিল। আর আজ? সাধারণ মানুষের সামনে দিয়ে একদল বিকারগ্রস্ত জানোয়ার যখন দু’টি অসহায় মেয়ের সামনে তাঁদের বাবা-মা-ভাইকে খুন করে, তাঁদের গণধর্ষণ করে বিবস্ত্র অবস্থায় রাস্তায় হাঁটিয়ে নিয়ে যেতে যেতে নানারকম যৌন নিগ্রহ আর পাশবিক উল্লাস করে তখন সেই মেয়েরা আর মায়েরা কোথায়? তাঁরা সদলে নেমে এসে পারলেন না সমবেত পদাঘাতে অসুর নিধনের পালা শুরু করতে! কুৎসিত এই নারীনিগ্রহের ঘটনা ঘটেছে ৪ মে। এফআইআর দাখিল হওয়ার কথা যেখানে এক ঘণ্টার মধ্যে সেখানে তা করতে সময় লেগেছে ১৪ দিন—১৮ মে। ২০ জুলাই এই ঘটনার জন্য গ্রেফতার করা হল ৪ জনকে। হ্যাঁ, দু’মাস সময় লাগল পুলিশের।

লজ্জার প্রতিবাদ। ছবি–সংগৃহীত

ঘৃণ্য নারী নির্যাতনের সেই দৃশ্য তাঁর গোচরে আসায় সুপ্রিম  কোর্টের মহামান্য প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বিষয়টি নিয়ে যথাযথ পদক্ষেপ করতে পেরেছেন।

      চরম নির্যাতিতাদের মধ্যে একুশ বছরের তরুণী জানিয়েছেন, তাঁদের বিফানম গ্রামে লুঠপাট চালিয়ে যখন মেইতেই সম্প্রদায়ের উন্মত্ত জনতা প্রতিটি বাড়িতে আগুন লাগাচ্ছিল তখন তাঁরা পাঁচজন ছুটে পালাতে থাকেন। পুলিশই তখন তাঁদের পথ আটকায় এবং অভিযুক্তদের হাতে তুলে দেয়। অভিযুক্তরা প্রথমেই তাঁর বাবাকে খুন করে, তারপর শেষ করে তার ১৯ বছরের ভাইটিকে। তাঁকে এবং ৪২ বছরের এক মহিলাকে বিবস্ত্র করে অভিযুক্তরা খোলা মাঠে নারীমেদ যজ্ঞ শুরু করে। মেয়েটি জানিয়েছে, ধর্ষকদের মধ্যে একজন ছিল তাঁরই ভাইয়ের বন্ধু। পুলিশ সূত্রের খবর– পশুর অধমদের সংখ্যা ছিল ৮০০ থেকে ১০০০। এই ঘটনা প্রসঙ্গে মণিপুরের নির্লজ্জ মুখ্যমন্ত্রী বিবৃতি দেওয়ার সময় বলেছেন, গত আড়াই মাস ধরে এই রকম ঘটনা শয়ে শয়ে ঘটেছে, কী করবে পুলিশ? কী অসাধারণ দায়িত্বশীল প্রশাসন! অবশ্য ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়ে তারা লোকচক্ষুর আড়ালে এতবড় একটা ঘটনাকে অনেকদিন আড়াল রাখতে পেরেছিল। এটাই বা কম কী!

      এত সতর্কতা সত্ত্বেও কে বা কারা এই ভিডিও করেছিল এবং সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছিল তা নিয়ে নিশ্চয়ই তদন্ত করা হবে আর সংশ্লিষ্টদের জন্য শিক্ষামূলক শাস্তির বিধান দেওয়া হবে। তবু, যে উদ্দেশেই এই ভিডিও যারাই প্রকাশ্যে এনে থাকুক না কেন দেশবাসী অন্তত জানতে পারল ঠিক কোন জায়গায় আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ এখন পৌঁছে যাচ্ছে প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তার কারণে। আর, ঘৃণ্য নারী নির্যাতনের সেই দৃশ্য তাঁর গোচরে আসায় সুপ্রিম  কোর্টের মহামান্য প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বিষয়টি নিয়ে যথাযথ পদক্ষেপ করতে পেরেছেন।

 মণিপুরের নির্লজ্জ মুখ্যমন্ত্রী বিবৃতি দেওয়ার সময় বলেছেন, গত আড়াই মাস ধরে এই রকম ঘটনা শয়ে শয়ে ঘটেছে, কী করবে পুলিশ?

      যেভাবে ধর্ষকদের প্রতি নেতাদের ও পুলিশ প্রশাসনের সহানুভূতি বেড়ে চলেছে তাতে শঙ্কা হয় অদূর ভবিষ্যতে এটা না একটা বিনোদন হয়ে ওঠে! অদূর অতীতে বিলকিস বানোর ধর্ষকরা সসম্মানে মুক্তি পেয়েছে। মহিলা কুস্তিগিরদের যৌন নিগ্রহকারী হিসেবে অভিযুক্ত ব্রিজমোহন সিংহর জামিনের বিরোধিতা করল না দিল্লি পুলিশ। রামরহিমের মতো ভয়ঙ্কর ধর্ষক ও খুনের অপরাধীও প্যারোলে জামিন পেয়ে যায়, আর তাকে সসম্মানে বরণ করে প্রকাশ্যে উল্লাস করাও চলে এই সমাজে। কত অনায়াসে এখন উন্নাও, হাথরস, কাঠুয়াকাণ্ড ঘটে চলে।

      সমাজে ক্রমাগত জঘন্য অপরাধ বেড়ে চলা একটি দিক। আর সেইসব ঘটনার প্রতিবিধান না হওয়ার ফলে অপরাধীদের অকুতোভয় হয়ে ওঠা আর একটা দিক। সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক হল মানবতাবিরোধী যাবতীয় ঘটনাকে স্বাভাবিক করে তোলা এবং ভয়ের কারণে হোক কিংবা নিস্পৃহতার কারণেই হোক আমজনতার নির্বিবাদে সবকিছু মেনে নেওয়া। শুধু নিজের ঘরটুকুর নিরাপত্তা অটুট আছে ভেবে যারা চোখ বন্ধ করে স্বস্তিতে আছে বলে মনে করে, প্রলয় এসে অচিরে তাদেরও গ্রাস করবে অতি সহজেই। একবিংশ শতাব্দীতে পৌঁছেও যে সভ্যসমাজ নারীকে পণ্য ছাড়া আর কিছু ভাবতে শেখেনি, সেই সমাজের বাই প্রোডাক্টরা নিয়মহীন জান্তব এক পৈশাচিক পৃথিবীতে রূপান্তরিত করবে মানুষের বাসস্থানকে। আমরা কি নীরবে দেখে যাব এই ধ্বংস? সমালোচনা, প্রতিবাদ, প্রতিকার শব্দগুলি অভিধান থেকে বিদায় নিলে জেগে থাকবে শুধু কিছু রক্তচক্ষু আর তার বিকট ক্ষুধা।

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here