থেমে নেই নির্যাতন, দেশের গর্ব মেয়েরা

প্রতীকী ছবি–সংগৃহীত।

অলিম্পিক্সের আসরে দেশকে সম্মানের আসনে বসাচ্ছেন মেয়েরা। আরেকদিকে পিছু ছাড়ছে না চরম নারী নির্যাতনের নিকৃষ্টতম একের পর এক ঘটনা। লিখছেন সফিউন্নিসা

জ গোটা দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে মেয়েরা। সেই মেয়েরা যারা অধিকাংশই উঠে এসেছে একেবারে সমাজের প্রান্তিক সীমা থেকে। অর্থাৎ সেই মেয়েরা যারা লড়াইয়ের ময়দানে একেবারে নিজস্ব চেষ্টা, অধ্যবসায় আর জেদ সম্বল করে সাফল্যের মুখ দেখছে। অবশ্যই পরিবার বাধা হয়ে ওঠেনি, তাই তো তারা সফল।

     চরম বৈপরীত্যের এই দেশ। তাই অলিম্পিক্সের বিশ্বজোড়া প্রতিযোগিতায় যখন এ দেশের মীরাবাঈ চানু, পি ভি সিন্ধু, লাভলীনা বরগোহাঁইয়ার মতো মেয়েরা দেশকে সম্মানের আসনে বসাচ্ছেন, তখন নিত্যদিনের মতোই সংবাদপত্রে উঠে আসছে চরম নারী নির্যাতন আর অবমাননার নিকৃষ্টতম নানা ঘটনা। যেমন, উত্তরপ্রদেশের এক সপ্তদশী নেহা পাসোয়ানকে তার পরিবারের লোকজন পিটিয়ে হত্যা করল শুধুমাত্র জিনস পরার অপরাধে। মধ্যপ্রদেশে মোবাইল ফোনে কথা বলার ‘অপরাধে’ দুই বালিকাকে বেদম গণপিটুনি দেওয়া হ’ল রাস্তায় ফেলে। কুৎসিত হাথরস-কাণ্ডের রেশ মেলাতে না মেলাতেই দিল্লির পুরানা নাঙ্গাল গ্রামে মাত্র ন’বছরের দলিত শিশুকন্যাকে কী নৃশংসভাবেই না হত্যা করা হ’ল! শ্মশানযাত্রীদের জলপানের কুলার থেকে সে বোতলে করে একটু জল আনতে গিয়েছিল। সেখানে তাকে গণধর্ষণ করে হত্যা করা হল। একশ্রেণির পুরুষের যৌনযন্ত্রণা কি একজন মানুষের মৃত্যুযন্ত্রণার চাইতেও বেশি কষ্টকর যে, তারা অনায়াসে একটি শিশুকে হত্যা করে প্রমাণ লোপাট করতে তার দেহটি জ্বালিয়ে দিতেও পিছপা হয় না? সামসেরগঞ্জেও যে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটে গেল তা-ও কি সহজেই ধামাচাপা পড়ে যাবে? সেখানে দশম শ্রেণিতে পাঠরতা কিশোরীটিকে অভিযুক্তরা অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে চরম নির্যাতন করে ন’ঘণ্টা পরে গুরুতর জখম অবস্থায় তাকে বাড়ির কাছে ফেলে দেয়। মেয়েটি তার কিছুক্ষণ পরে মারা যায়।

   এখনও সমাজের একটা বড় অংশের পুরুষের কাছে নারী মানেই পুরুষের ভোগ্যা। তার জন্য ঘটে যায় নির্ভয়া-কাণ্ড, ঘটে যায় হাথরস, ঘটে যায় কামদুনি। অথচ, দেশকে মেয়েরা বিশ্ব দরবারে তুলে ধরছে সম্মানের আসনে।

     এই তো এ দেশের সামাজিক চিত্র, হ্যাঁ এই আমাদের ডিজিটাল ইন্ডিয়া, যেখানে একটি কৃতী মেয়ে তার বাবার প্রতি শ্রদ্ধা জানায় শুধুমাত্র তাকে শৈশবে খুন না করার জন্য, বাবা মেয়েকে সাফল্যের স্তরে ওঠার সময়কাল পর্যন্ত বেঁচে থাকতে দিয়েছেন বলে। আবার বিভিন্ন রাজ্যের পঞ্চায়েত এখনও ঠিক করে দেয় মেয়েরা মোবাইল ফোন ব্যবহার করলে তাকে কী শাস্তি দেওয়া হবে, সন্ধের পর বাড়ির বাইরে বের হলে কেমন ‘শিক্ষা’ দেওয়া উচিত, প্রেম করার স্পর্ধা দেখালে তার অভিভাবকরা কী ব্যবস্থা নেবে, ভিন জাতের ছেলের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লে সেই মেয়েকে গণধর্ষণের বিধান পর্যন্ত দেওয়া হয়, এমনকী তা কার্যকরী হতেও দেখা যায়। মোটের ওপর পুরুষের তথা  সমাজের ইচ্ছায় এবং অনুগ্রহে মেয়েদের বেঁচে থাকতে হবে। বারে বারে তাদের শৈশব থেকে এমন সবক শেখানো হয়, যাতে পরিবারের পুরুষদের তাদের মেনে নিতে হয় হর্তা-কর্তা-বিধাতা হিসেবে। এর অন্যথা হলেই তাদের বেঁচে থাকা অনিশ্চিত হয়ে যাবে মুহূর্তেই।

     যে কোনও ঘটনার সাফল্যে বৎসরান্তে তার ‘জয়ন্তী’ পালিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রথম বছর থেকে তার বাৎসরিক বয়স গণনা করা হয়। এ দেশে কবে থেকে নারী নির্যাতন, নারী অবমাননা, নারীহত্যা সমাজে সাফল্যের সঙ্গে আজ পর্যন্ত পালিত হয়ে চলেছে, তার হিসেব কেউ রাখেনি। তবে ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো কিছু পরিসংখ্যান মাঝে-মধ্যে প্রকাশ করে থাকে। অবশ্যই হিমশৈলের চূড়াটুকুর মতো যেটুকু  নথিভুক্ত হয়, সেগুলির ভিত্তিতে। তাই মনে পড়ে যায় রাজস্থানের ভানোয়ারি বাঈয়ের কথা। যিনি সমাজকর্মী হিসেবে চেয়েছিলেন মেয়েদের মধ্যে চেতনা জাগাতে। পুরুষতন্ত্রের অচলায়তনে ঘা পড়ার আশঙ্কায় তাঁকে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল গণধর্ষণের অমোঘ অস্ত্রে। চরম অসুস্থ, বিধ্বস্ত এই নারী কিন্তু লড়াইয়ের ময়দান ছাড়েননি। কিন্তু সমাজের প্রতিটি স্তর যেখানে যুগ যুগ ধরে পুষ্ট হয়েছে পুরুষের আস্ফালন আর নারীর অসহায় আত্মসমর্পণ, সেখানে নারীর সুবিচার পাওয়ার পথটি অত সহজ নয়। এই সময়েও প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হলে মাঝে-মধ্যে অ্যাসিড ছুড়ে মেয়েটির মুখ সারাজীবনের মতো বিকৃত করে দিয়ে প্রতিশোধ (?) নেওয়ার ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। বিয়ের প্রস্তাবে রাজি না হলে মেয়েকে তুলে নিয়ে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে মিলে তাকে গণধর্ষণ করে উচিত ‘শিক্ষা’ দিয়ে পৌরুষ জাহির করে কিছু পুরুষ। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা কোনও বন্ধুর জন্মদিন পালন করার অজুহাতে বান্ধবীকে নিমন্ত্রণ করে ডেকে এনে ঘুমের ওষুধ মেশানো পানীয় দিয়ে তাকে অর্ধ অচেতন অবস্থায় সদলে ধর্ষণ করেছে, এমন ঘটনা অনেকবারই ঘটেছে। অর্থাৎ একজন অশিক্ষিত ছেলে যে মানসিকতা নিয়ে সদলে বিবাহে অনিচ্ছুক প্রেমিকাকে গণধর্ষণ করে, একজন তথাককথিত উচ্চশিক্ষিত, সমাজের উচ্চস্তরের ছেলেও একই মানসিকতা নিয়ে একই কাজ করে। অর্থাৎ মেয়েদের স্বাভাবিক প্রাপ্য সম্মান দেওয়া বা সমপর্যায়ের মানুষ ভাবার শিক্ষা কারওর নেই। তাই

     আজ তথাকথিত আধুনিক সভ্যতা কোথাও কোথাও নারীর পোশাকে বিপ্লবটুকু মেনে নিয়ে ‘উদারতা’র ধ্বজা ওড়াচ্ছে। একসঙ্গে নাচ-গান-হইহল্লা অথবা সমবেত মদ্যপানে আধুনিকতা দেখাচ্ছে একশ্রেণির পুরুষ। ব্যক্তিগত সম্পর্কের পরিসরে লোকচক্ষুর আড়ালে বেরিয়ে পড়ছে তাদের ঝুলি থেকে হাজার বছর ধরে আদরে পুষে রাখা বেড়ালটি। যার নাম পুরুষতন্ত্র। নারীকে স্বতন্ত্র একজন ব্যক্তিমানুষের সম্মান দিতে পারেন ক’জন? এইসব অতি আধুনিক হিসেবে নিজেদের জাহির করা পুরুষেরাও কি দেন ব্যক্তিগত জীবনে?

     আমাদের সমাজে অধিকাংশ পরিবারে স্ত্রী মানে ব্যক্তিগত সম্পত্তি (সম্পদ নয়)। বেশিরভাগ পুরুষের কাছে তারা শ্বশুরবাড়ি থেকে কিনে আনা জীব। রূঢ় ভাষায় বললে সর্বার্থে ভোগের সামগ্রী। হ্যাঁ আজও, এখনও সমাজের একটা বড় অংশের পুরুষের কাছে নারী মানেই পুরুষের ভোগ্যা। তার জন্য ঘটে যায় নির্ভয়া-কাণ্ড, ঘটে যায় হাথরস, ঘটে যায় কামদুনি। অথচ, দেশকে মেয়েরা বিশ্ব দরবারে তুলে ধরছে সম্মানের আসনে। দেশ তাদের সম্মান দেবে কবে? একজন ব্যক্তিনারীকে তার অবদানের জন্য সম্মান বা অর্থ পুরস্কার দিলেই হয় না। গোটা নারীসমাজকে দিতে হয় ব্যক্তিমানুষের সম্মান। তাদের জন্য চাই রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা। আর পুরুষকুলকে মানসিকভাবে শিক্ষিত হতে হবে, প্রস্তুত হতে হবে কোনও মানুষকে নারীপুরুষ নির্বিশেষে ‘মানুষ’ হিসেবে ভাবার জন্য।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here