মেয়েদের অকাল বিয়ে

প্রতীকী ছবি–সংগৃহীত।

কন্যাশ্রী থেকে রূপশ্রী–বাল্যবিবাহ রুখতে এমন প্রকল্প নজর কাড়লেও পশ্চিমবঙ্গ-সহ বিভিন্ন রাজ্যে মেয়েদের অকালে বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। পরিসংখ্যান এমনটাই বলছে। কিন্তু গলদটা কোথায়?  লিখছেন সফিউন্নিসা

জ্জাগত কিছু কিছু বদ অভ্যাসকে আমরা ঐতিহ্য বলে দাগিয়ে দিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসার সবরকম প্রয়াসকে বারবার রুখে দিয়ে নিজেদের বিজয়ী ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভ করে আসছি। তার মধ্যে অন্যতম হ’ল বাল্যবিবাহ। পঞ্চম জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার ( এনএফএইচএফ ) সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে, এখনও গ্রামীণ এলাকায় বাল্যবিবাহের হার উদ্বেগজনক। সেখানে আজও ৪৮.১ শতাংশ কন্যা বাল্যবিবাহের শিকার। শহরে এই হার ২৬.২ শতাংশ। কয়েক দশক আগে অবশ্য শিশুকন্যার বিবাহের হার এতটাই বেশি ছিল যে, ইংরেজ সরকারের কাছে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা এই বিষয়ে আইন প্রণয়ন করে শিশুকন্যাবিবাহ রদ করার আবেদন জানায়। এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন অক্ষয়কুমার দত্ত, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ।

    আমাদের শিক্ষা, চেতনা, আধুনিকতা, অস্মিতা, আত্মশ্লাঘার মুখে এবার বেশ করে ঝামা ঘষে দিয়েছে কয়েকজন মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। এদের কেউ পরীক্ষা চলাকালীন সন্তান জন্ম দিয়ে হাসপাতালে বসে পরীক্ষা দিয়েছে, কেউ পরীক্ষার দিনেই প্রসব যন্ত্রণা শুরু হওয়ায় বাকি পরীক্ষা দিতেই পারেনি। আর একটি ঘটনা তো সবকিছু ছাপিয়ে গিয়ে সমাজের কদর্য চেহারাটাকে অনাবৃত করে দিয়েছে। বালিকা স্ত্রী জেদ করে পরীক্ষা দিতে এলে তার মুখে অ্যাসিড ছুঁড়ে দিয়ে স্বামী উপযুক্ত শিক্ষা দিয়েছে।

 সরকারের রূপশ্রী প্রকল্পে বিয়ের অনুদান নিয়ে যতই ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ হোক না, এর একটি ইতিবাচক দিকও তো রয়েছে। তার সুযোগ নিতে গেলে নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

    মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী মা হচ্ছে। তার অর্থ হল তাকে ১৩/১৪ বছর বয়সেই বিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার শ্বশুরবাড়ির বা তার স্বামীর চেতনা কোন স্তরের হলে পরীক্ষার মুখেই তাকে মা হওয়ার পরীক্ষায় বসতে হয়! তাদের কাছে পড়াশোনার জন্য সময় দেওয়া বাহুল্য। অল্প বয়সে অপুষ্ট সন্তান পৃথিবীতে আনা অনেক বেশি জরুরি কাজ। দায়িত্বজ্ঞানহীন স্বামী কোনওদিন এ সব নিয়ে ভাবতে শেখেনি। অন্যদিকে, বাবা-মা কন্যাসন্তানকে বোঝা না ভাবলে যেন তেন প্রকারেণ এ ভাবে অকালে মেয়ের জীবন নষ্ট করতেন না।

    কন্যাদের আরও বেশি করে স্কুলমুখী করার জন্য এবং বাল্যবিবাহ রদ করার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার কন্যাশ্রী প্রকল্প চালু করেছে। গ্রামীণ জীবনে যানবাহনের অভাব থাকায় মেয়েদের পায়ে হেঁটে স্কুলে যাওয়া আসায় কিছু ঝুঁকি থাকায় প্রাইমারি বিদ্যা শেষে আর হাইস্কুলের মুখ দেখতে পেত না অধিকাংশ ছাত্রী। এখন তাদের সাইকেল দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। তার সুযোগ নিয়ে মেয়েরা হাইস্কুলে পড়াশোনা করে জীবনে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরুও করেছে। ফিবছর মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর হার তা বলেও দিচ্ছে। কিন্তু তাতে নাবালিকা বিবাহ বিশেষ হ্রাস পায়নি।

    সরকারের রূপশ্রী প্রকল্পে বিয়ের অনুদান নিয়ে যতই ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ হোক না, এর একটি ইতিবাচক দিকও তো রয়েছে। তার সুযোগ নিতে গেলে নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। অর্থাৎ সেই সময়কালে পড়াশোনা সে করুক, পরিণত বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসুক। তবে এখনও কেন নাবালিকা বিবাহ? কয়েক দশক আগে সমাজে ছিল শাস্ত্রীয় বিধানের নামে পুরুষতন্ত্রের ধ্যাষ্টামি—নাবালিকা কন্যার বিবাহ না দিলে তার পিতার সাত পুরুষ নরকস্থ হবে। মেয়েদের লেখাপড়া? তাতে তো বৈধব্য অবধারিত। তা ছাড়া লিখতে শিখলে পরপুরুষকে চিঠি লিখে সে পাপিষ্ঠা হবে। তাই শৈশবেই তাকে পাত্রস্থ করার ‘সুচিন্তিত’ বিধান। তাই তো সারদা আইন পাশ যাতে না হয়, তার জন্য জান লড়িয়ে দিয়েছিল সমাজের গুরুমশাইরা। সেই সময়ে তড়িঘড়ি শিশুকন্যাকে বিয়ের নামে বলি দেওয়ার হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। তারপরে চারের দশক থেকে দেশভাগের কারণজনিত সামাজিক অভিঘাতে অনেক বজ্রআঁটুনি শিথিল হয়ে যায়। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে লেখাপড়া শিখে চাকরি পাওয়ার আশায় মেয়েরা ঘরের বাইরে পা রাখতে শুরু করে। তখনও অবশ্য সংসার (এখনও নয় কি!) হাড়ে হাড়ে তাদের বুঝিয়ে দিত সংসার-সন্তান-ঘরের কাজ সবটাই মেয়েদের মূল কাজ। চাকরি করে সংসারে সাশ্রয় আনলেও অপরাধবোধে ভোগার সরঞ্জাম সবসময় তাদের জন্য মজুত থাকত ।

মেয়েঘটিত অপরাধ-নির্যাতন-নিপীড়নের ক্ষেত্রে তাদের রেয়াত না করে অপরাধীদের পংক্তিতে রেখেই বিচার করা হোক।

    আর এখন অত্যাধুনিক সমাজে, এই একবিংশ শতকে এখন নারীসমাজ আড়াআড়ি বিভক্ত। শহুরে সুশিক্ষিতারা পুরুষের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেই আপন যোগ্যতায় জিতে নিচ্ছে যার যা প্রাপ্য। তার শতাংশ অবশ্য নগণ্য। বাকিরা? মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে হাজারো প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে। আর, গ্রামীণ নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েরা ? তারা স্বপ্ন দেখতে ভয় পেয়ে এসেছে বরাবর। সরকারি সুযোগ সুবিধা কিছু পাওয়ার পর তারা এগিয়ে আসছিল পড়াশোনার জন্য। কিন্তু সমাজ? প্রান্তিক জীবনে সমাজের অচলায়তন প্রায় তেমনই রয়ে গিয়েছে। ইচ্ছুক বাবা-মায়েরাও মেয়েকে বেশিদিন ঘরে রাখতে সাহস পাচ্ছেন না। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তা বলে কিছু নেই। আইনের শাসন রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক রং বিবেচনা করে প্রযুক্ত হয়। কে নেবে মেয়ের নিরাপত্তার দায়িত্ব!

    আসলে সমাজের গড় দৃষ্টিভঙ্গি তো সেই একই জায়গায় রয়ে গিয়েছে—মেয়ে মানেই লোভনীয় ভোগসামগ্রী। প্রভাব-প্রতিপত্তিহীন মানুষের ক্ষেত্রে যা ইচ্ছা অন্যায় করে অনায়াসে পার পাওয়া যায়। এই স্তরে বসবাসকারী মানুষ বিলক্ষণ জানেন সেটি। তাই তাঁরা তড়িঘড়ি কন্যাকে পাত্রস্থ করে নিশ্চিন্ত হতে চান। এরপরে তো সবচেয়ে বড় কারণ হল কোভিড-পরবর্তী শোচনীয় পরিস্থিতি। গ্রামীণ অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। কারও হাতে কাজ নেই। অন্ন সংস্থান রীতিমতো দুরূহ হয়ে উঠছে। সরকারি রেশন ও ভাতা অপ্রতুল, তা-ও সবার ভাগ্যে জোটে না। এই রকম সংকটময় সময়ে যা সর্বত্র ঘটে তা-ই ঘটছে। আড়কাঠিরা বালিকা-শিশু-মাংসের ব্যবসায় নেমে পড়েছে। দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে বিয়ে দেওয়ার নাম করে পাচারের কাজ চলছে পুরোদমে। আমফানে আর কোভিডে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া পরিবারগুলির কাছে সুস্থভাবে বেঁচে থাকাটাই চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। এই সময়ে কন্যাকে ঘর থেকে কোনওরকমে বিদায় করে তাঁদের অনেকেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে চাইছেন। বাল্যবিবাহ বন্ধের জন্য আগে মেয়েদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করাটাই সবচেয়ে জরুরি কাজ। আইনের শাসন যাতে কোনও ধর্ম-বর্ণ-অর্থনৈতিক অবস্থা নির্বিশেষে বলবৎ হয়, সেই বিষয়টাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। যে পরিবার পুত্রসন্তানকে মেয়েদের সম্মান করতে না শেখায়, সে যতবড় পরিবার থেকে আসুক  না কেন, মেয়েঘটিত অপরাধ-নির্যাতন-নিপীড়নের ক্ষেত্রে তাদের রেয়াত না করে অপরাধীদের পংক্তিতে রেখেই বিচার করা হোক। তারা যেন অকুতোভয় না হয়ে ওঠে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here