কেরলে মন্দিরে অবাক কাণ্ড!

প্রতীকী ছবি– সংগৃহীত।

ন্দিরে পুজো হচ্ছে। আর সেই সময় ভক্তিমূলক গান বাজছে না। বাজছে প্রতিবাদী গান। সিপিআইএমের কেরলে এমন-ই অবাক করা কাণ্ড।

      পশ্চিম বঙ্গে একটানা ৩৪ বছর ধরে ক্ষমতায় ছিলেন বামপন্থীরা। কিন্তু তখন-ও কোনও মন্দিরে প্রতিবাদের গান বেজেছে এমনটা শোনা যায়নি। তবে বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভায় থাকাকালীন কম্যুনিস্ট নেতা সুভাষ চক্রবর্তী একবার তারাপীঠ মন্দিরে তারামায়ের পুজো দিয়ে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। আর এ বার কেরলে মন্দিরে প্রতিবাদের গান বাজালেন সিপিআইএমের যুবনেতা-নেত্রীরা। টিভি ৯-এর খবর অনুসারে এই উদ্যোগ নেয় বামেদের যুব সংগঠন ডিওয়াইএফআই। গোটা ঘটনায় ক্ষুব্ধ কেরলের বিরোধী নেতৃত্ব। তাঁদের প্রশ্ন– মন্দিরে কেন এই ধরনের গান বাজানো হল?

       মন্দিরে গণসংগীত। এই ধরনের গান বাজানোর বিরোধিতা করেছে কেরলের কংগ্রেস নেতৃত্ব। বিরোধী দলনেতা ভি ডি সতীসনের দাবি– মন্দির কোনও প্রতিবাদী বা বিপ্লবী গান গাওয়ার জায়গা নয়। ক্ষমতার জেরে ওরা অন্ধ হয়ে গিয়েছে। এ নিয়ে কেরলের মন্দির কমিটি ত্রিভাঙ্কুর দেবস্বম বোর্ডের সভাপতি পি এস প্রশান্ত জানিয়েছেন, কোল্লাম জেলার কাড্ডাকাল মন্দিরে গণসংগীত বাজানোর তদন্ত করা হচ্ছে। সেই তদন্তের রিপোর্টের ভিত্তিতেই যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেই সঙ্গেই তিনি বলেছেন– এর আগেও মন্দির চত্বরে রাজনৈতিক গান বাজানো ও দলের পতাকা ঝোলানো নিয়ে কড়া নির্দেশ দিয়েছিল হাই কোর্ট। কিন্তু তারপরেও এমন কাণ্ড অপ্রত্যাশিত।

      এ নিয়ে কেরলের ডিওয়াইএফআই নেতৃত্বের কোনও প্রতিক্রিয়া জানা না গেলেও ‘গণসংগীতের উৎস সন্ধানে’ গীতিকার এবং সুরকার সলিল চৌধুরির কথায়– বাংলার কীর্তনাঙ্গ গান মূলত প্রেমরসের ভক্তিরসের গান। তাই ‘ওই অঙ্গে কোন বলিষ্ঠ গান  রচনা সম্ভব নয়’, এ কথা তিনি প্রায়শই শুনতেন কয়েকজন পেশাদার সুরকারের মুখে। তাই সলিল চৌধুরি গানটি রচনা করেছিলেন ‘যমুনে তুমি কি সেই যমুনে প্রবাহিনী’ সুরটিকে ভেঙে।   বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনের সময় গানটি খুবই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। বলিষ্ঠ  প্রতিবাদের এর চেয়ে বড় নজির আর কি হতে পারে– লিখেছেন সলিল। স্মৃতিচারণায় তিনি আরও লিখেছেন–অসমের  ‘বিহু’ গানের সুরও মূলত আনন্দোচ্ছ্বল প্রেমরসাত্মক নৃত্যের সহযোগী সংগীত। ওই সুরকে ভিত্তি করে আমি সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী গান রচনা করি— ‘ও মোদের দেশবাসীরে/ আয়রে পরান ভাই আয়রে রহিম ভাই/ কালো নদী কে হবি পার’— গানটি। ওই একই সুরে ফুটে ওঠে একটি উদ্দীপ্ত আহ্বান। আবার একই সুরে বিষাদের ছায়া নেমে আসে ‘গাঁয়ের বধূ’ গানের শেষ চরণে— ‘আজও যদি তুমি/ কোন গাঁয়ে দেখ ভাঙা কুটিরের সারি’। তাঁর কথায়– সুরকার হিসাবে আমার শিক্ষা এই যে প্রয়োগ-পদ্ধতির ওপর নির্ভর করে একটি সুর শ্রোতাদের মনে কোন রস উৎপাদন করবে।

      এ কারণেই নিগ্রোদের ধর্মীয় গানের বেদনা ভরা হতাশার সুরে বাঁধা পল রবসনের কণ্ঠে ‘ওল্ড ম্যান রিভার’ একটা উত্তরণ ঘটায়, আবার প্রায় ওই একই সুরে ভূপেন হাজারিকার ‘গঙ্গা তুমি বইছ কেন?’ অন্যতর এক আকুতি জাগায়। এ কারণেই কি কেরলের ডিওয়াইএফআই গণসংগীত পরিবেশনের জন্য মন্দিরকে বেছে নিয়েছে! সলিল চৌধুরির কথায়–আজও সেই চেতনা জীবনের প্রতি মুহূর্তে ভালমন্দ বুঝতে শেখায়, ভয়কে জয় করতে শেখায়। কুসংস্কার, ধর্মান্ধতাকে যুক্তিবাদের শাণিত অস্ত্র দিয়ে খণ্ডন করতে শেখায়। যে-উৎসভূমি থেকে গণসংগীতের ধারা নেমে এসেছিল। সেই একই উৎসভূমি থেকে উদ্গত জীবন-দর্পণ আমাদের হতাশায় আলো জ্বেলে দেয়, মানবজাতির উজ্জল ভবিষ্যৎ যে ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে আসতে বাধ্য সেই আশাবাদ এবং প্রত্যয় জীবন সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে। তাই বেঁচে থাকা সার্থক হয়।

      এই সত্যকে পাথেয় করে ‘গণসংগীত’ দেবতার পুজোর আঙিনায় পরিবেশন করা সমীচীন কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক উসকে দিল কেরলের ডিওয়াইএফআই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here