স্যালুট, আফগানিস্তানের মেয়েরা!

আফগান মেয়েরা। ছবি–সংগৃহীত।

তালিবানদের চোখে নারী মানুষ নয়, ভোগসামগ্রী। নারীরা তা মানবে কেন? লিখছেন সফিউন্নিসা

    কটি দরিদ্র দেশ। যেখানে অধিকাংশ মানুষ বাস করেন দারিদ্রসীমার নীচে। সুজলা, সুফলা তো নয়ই, মরু। কাজেই ফসল সহজলভ্য নয়। সে দেশের সঙ্গে আমাদের দীর্ঘকালের সুসম্পর্ক। বছরের পর বছর সহজ-সরল মানুষগুলি জীবিকার তাগিদে পরিবার দেশে রেখে এসেছে এখানে। আপন করে নিয়েছে এ দেশকে। উপার্জন শেষে ফিরে গিয়েছে, আবারও এসেছে। রবিঠাকুরের কাবুলিওয়ালার রহমতরা এ ভাবেই বেঁচে থাকার পথ খুঁজে নিয়েছিল। দেশটির দুর্ভাগ্য কোটি কোটি ডলারের খনিজসম্পদ বুকে নিয়েই সে গরিব। আর ধনী দেশের লোভী হানাদাররা তাদের দেশের উন্নতি ঘটানোর নাম করে এসে দখল নেয়। তারপরে স্বার্থসিদ্ধি যতটা সম্ভব করে পিঠটান দেয়। আসে অন্য লুটেরার দল।

    ধারাবাহিক এই বঞ্চনার মধ্যেও আফগানিস্তানের মানুষ স্বপ্ন দেখেছে। অনেক কিছু ‘নেই’-এর মধ্যেও শিক্ষিত হওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা আর মেয়েদের শিক্ষিত করার সক্রিয় পদক্ষেপে গত দু’দশকে আফগানি মেয়েরা অন্দরমহলের জীবন ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল। সরকারি সব দফতরে তাদের উপস্থিতি, বিমান চালানোর পেশায় ঢুকে পড়া, এমনকী সেনাবাহিনীতে যোগদানের প্রস্তুতি–সবকিছু তালিবান নামক এক ‘দানব’ দলের আগ্রাসনে হারিয়ে যেতে বসেছে। যেমন হয়েছিল কুড়ি বছর আগেও। সে-ও এই তালিবান নামক ভয়ঙ্কর অশুভ শক্তির অভ্যুত্থানে। এ দেশে বসে থেকে যে সব বেনিয়া লুঠ করছিল এদের সম্পদ, তারা অনায়াসে এই ভয়ঙ্কর পিশাচদের হাতে দেশটিকে ছেড়ে দিয়ে পাততাড়ি গুটিয়ে চলে গেল।

 মেয়েরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে চারদিককার প্রতিকূলতার সঙ্গে যুঝতে যুঝতে বুঝে নিয়েছেন নিজেদের জায়গা। সেই লড়াই এখনও সর্বত্র নানারূপে, নানা চেহারায়।

    প্রতিরোধহীন ময়দানে খুব সহজেই তারা সবকিছুর দখল নেবে, তালিবানদের এমন আগ্রাসী বিশ্বাস এ বার কিন্তু ধাক্কা খেল। যদিও তাতে তারা দমেনি। গণতন্ত্রপ্রিয় আফগানি মানুষগুলির উপর নির্বিচারে গুলিবৃষ্টি করে অসংখ্য প্রাণহানি ঘটিয়ে তারা দখল করেছে এক একটি অঞ্চল। মেয়েদের ওপর এই পিশাচদের অত্যাচার পৃথিবীর ইতিহাসে অতীতে ঘটলেও আধুনিক দুনিয়ায় তার নজির মেলে না। মেয়েদের শিক্ষার ওপর প্রথম আঘাত—তাদের কাজ  পুরুষের সেবা আর সন্তান উৎপাদন, এই ফতোয়া তারা শুনিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, তা কার্যকরও করে ফেলতে শুরু করেছে। রাস্তায় পুরুষ সঙ্গী ছাড়া বেরনো যাবে না। সর্বাঙ্গ ঢাকতে হবে বোরখায়। আরও অসংখ্য ফতোয়া। এখানেই শেষ নয়, তেরো-চোদ্দ বছরের মেয়েদের তারা বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ের প্রহসন করে ভোগ করছে। মেয়েদের প্রতিবাদী মিছিলের উপর নির্বিচারে লাঠিবাজি, মেরে মুখ ফাটিয়ে দেওয়া—হেন অত্যাচার নেই তারা করছে না। বিশ্ব মানবাধিকার কমিশন নিদ্রা গিয়েছেন।

 আসলে মেয়েদের প্রতি পুরুষের তথা সমাজের দৃষ্টিভঙ্গী যতদিন না বদলাবে, ততদিন মেয়েরা অত্যাচারিত হতেই থাকবে। তার ওপর তালিবানরা তাদের সমস্ত রকম অপকর্মের সঙ্গে ধর্মের মনগড়া ব্যাখ্যা মিশিয়ে বানিয়ে তুলেছে যত কানুন, যা ধর্মকেই কলুষিত করছে।

    এরই মধ্যে কাবুলের মেয়েরা দলবদ্ধভাবে দীর্ঘ মিছিল করেছে নিজেদের অধিকার রক্ষার দাবিতে। প্রাণ যে কোনও মুহূর্তে চলে যাবে জেনেও। সংবাদপত্রের ছবিতে দেখা গিয়েছে উদ্যত আগ্নেয়াস্ত্রের সামনে দাঁড়িয়ে এই মেয়েরা শ্লোগান দিচ্ছে। স্যালুট জানিয়েছে বিভিন্ন দেশের অসংখ্য মানুষ। শিক্ষার আলো যাদের চেতনা জাগিয়ে দিয়েছে, তারা তো মানুষের অধিকার চাইবেই। তালিবানদের চোখে নারী মানুষ নয়, ভোগসামগ্রী। নারীরা তা মানবে কেন? গায়ের জোরে পুরুষেরা চিরকালই মেয়েদের দাসী বানিয়ে রেখেছে সব জায়গাতেই। এই দাসত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন মেয়েরা। ব্যতিক্রমী দু’একজন মানুষ (তথাকথিত পুরুষ নয়) তাঁদের লড়াইয়ের পথ খুলে দিয়েছেন। মেয়েরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে চারদিককার প্রতিকূলতার সঙ্গে যুঝতে যুঝতে বুঝে নিয়েছেন নিজেদের জায়গা। সেই লড়াই এখনও সর্বত্র নানারূপে, নানা চেহারায়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কী না ঘটে! বিয়ের আটমাসের মধ্যেই অন্তসত্ত্বা বধূ খুন হয়ে যায় শ্বশুরবাড়ির লোকের হাতে, তিন বছরের শিশু থেকে সাত-আটের বালিকাদের ধর্ষণ করে হত্যা চলছে । এ সব তো ঘরের পাশের ঘটনা। যারা এই দৃষ্টিতে মেয়েদের দেখে, তাদের সম্মিলিত রূপই তো তালিবানি চেহারায় প্রকট হয়ে ওঠে।

    আসলে মেয়েদের প্রতি পুরুষের তথা সমাজের দৃষ্টিভঙ্গী যতদিন না বদলাবে, ততদিন মেয়েরা অত্যাচারিত হতেই থাকবে। তার ওপর তালিবানরা তাদের সমস্ত রকম অপকর্মের সঙ্গে ধর্মের মনগড়া ব্যাখ্যা মিশিয়ে বানিয়ে তুলেছে যত কানুন, যা ধর্মকেই কলুষিত করছে। তারা নিজেরাও নিজেদের মনুষ্যত্বহীন এইসব কাজকর্মকে ধর্মীয় বিধান বলে বিশ্বাস করে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। শক্তি কুক্ষিগত করার জন্য সবরকম নীতিহীন পথ নিয়ে যারা চলে, তাদের কাছে ধর্মকে ব্যবহার করা একটা প্রচলিত পন্থা ছাড়া আর কিছু নয়। আর সেটা যে সবদেশেই চলে, তা-ও কারও অজানা নয়। শুধু তার চেহারাটাই যা আলাদা।

    মেয়েদের শুধু জেনে রাখা ভালো, ধার্মিক-অধার্মিক নির্বিশেষে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তাকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে রাখা হবেই। কোথাও নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে, কোথাও ভালোবাসার অভিনয় দিয়ে, আবার কোথাও সরাসরি বুঝিয়ে দিয়ে। রক্তচক্ষু না হলে বেয়নেটের খোঁচা, যৌননিগ্রহ না হলে হত্যা–পোষ না মানলে অনেক কিসিমের ওষুধ মজুত আছে, যার জন্য যেখানে যেমন প্রয়োজন তার প্রয়োগের লাইসেন্স তো পুরুষেরই হাতে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here