এসো ভালবাসা, আনো শান্তি

পৃথিবী, মানুষ, স্বাধীনতা, ভালবাসা এবং পুজো। প্রতীকী ছবি-সংগৃহীত।

বাতাসে পুজোর গন্ধ। এই আবহে মনের গহনে বিশ্বলোকের সাড়া পেতে লিখছেন সফিউন্নিসা

    ‘তখন তো বেড়াতে আসার সময় নয়, অনেকেই যাচ্ছে নির্বাসনে/তখন হিংসেয় জ্বলছে শহর, মানুষের হাতের ছুরি গেঁথে যাচ্ছে মানুষেরই বুকে/ রাস্তায় বসে লাশের আগুনে পুড়িয়ে খাচ্ছে ধর্ম/রক্তবমির মতন ওগরাচ্ছে দেশপ্রেম…….’ (নীরা হারিয়ে যেও না: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)

ঞ্চাশ বছর আগে ফিরে দেখা এক শারদপ্রাতের ঢাকের বাদ্যি আর ‘মেরা জুতা হ্যায় জাপানি’র চিরকালীন সেই মাদকতা, ছুতোনাতায় টুক করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্যান্ডেলের সামনে বারবার গিয়ে দাঁড়ানো। মাইকে তখন বাজছে ‘খিড়কি থেকে সিংহ দুয়ার এই তোমাদের পৃথিবী….’। ছোটবেলায় আমাদের কোনও দাদা ছিল না, সব মামা। কেননা আমার নিজের দাদা ছিল না। সেই জায়গা অনেকটা পূরণ করেছিল আমার ছোটমামা, সে তখন এইট-নাইনের ছাত্র। আমার ছ’সাত বছরের অস্তিত্ব তার কাছে ছিল নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর, তার পাড়াতুতো বন্ধুদের কাছেও তাই। সেই জন্যই হয়তো সবসময় শাসন আর মৃদু বকাবকিই জুটত কপালে। বড় হয়ে ওঠার সময়েও ঠিকমতো বড় হয়ে উঠতে পারিনি। প্যান্ডেলে নানা কাজে ব্যস্ত মামার দল হয়তো একবার জিজ্ঞাসা করতো ‘কি রে প্রসাদ পেয়েছিস?’ আমাদের দু’বোনের তাতে কিছু যেত আসতো না। আমরা দুর্গা ঠাকুরের সাজসজ্জা আর রণদৃপ্তা বীরাঙ্গনা মূর্তির দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকতাম। ভাবতাম কত কিছু। বাড়ি ফিরে আমার চেয়ে দু’বছরের ছোট বোন তার প্রশ্নের ডালি উজাড় করে দিয়ে উত্তরের জন্য সাগ্রহে তাকিয়ে থাকতো মুখের দিকে। ছ’বছর বয়সি মস্ত বিজ্ঞ দিদি আমি গম্ভীর মুখে মনগড়া যা সব  উত্তর দিতাম তা শুনে ও নিশ্চিন্ত বিশ্বাসে সারাক্ষণ জুড়ে থাকত আমার সঙ্গে।

    একবার বেশ বিপাকে পড়লাম। এ বার প্রশ্ন ছিল, মা দুগ্গা খিচুড়ি, লুচি, মিষ্টি আর এত ফল খান কোন হাত দিয়ে? সম্মান প্রায় যায় যায় আমার। অগতির গতি ছোটমামাকে হন্যে হয়ে খুঁজছি। বাড়িতে কোথাও না পেয়ে অগত্যা প্যান্ডেলে ছুটলাম। বেশ কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে মামা তখন ব্যস্ত। আমার জ্ঞানগম্যি চিরকালই বেশ ঘাটতির দিকে। স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনা করার মতো জ্ঞানবুদ্ধিও ছিল না। তাই নানা কোলাহলের মধ্যে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য চিৎকার করে প্রশ্নটা করতেই সমবেত একটা অট্টহাসির হট্টরোল। সেইদিন থেকে অনেক বড় বয়স পর্যন্ত–প্রায় মাধ্যমিক পর্ব পর্যন্ত পাড়াতুতো মামাদের টিজিং চলত এটা নিয়ে।

    আমার কিশোরীবেলায় পুজোর ক’দিন বাঁধা থাকতো বান্ধবীদের বাড়িতেই। আমাদের সম্ভ্রান্ত রক্ষণশীল পরিবারে আমার মা-ই এনেছিলেন সংস্কারমুক্ত বিশুদ্ধ সবুজ হাওয়া। আমাদের অনেক আত্মীয়-স্বজন যে আমার এ ভাবে নির্বিচার মেলামেশা ও খাওয়া দাওয়া ভালো চোখে দেখতেন না, তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু  সে সব আমাকে আটকাতে পারেনি। আমাদের বাড়িতে ঈদের দিনে মামার জনা পনেরো-ষোলো বন্ধুর জন্য দিদিমাকে স্পেশাল বিরিয়ানি আর শামি কাবাবের ঢালাও ব্যবস্থা রাখতে হতো। লাচ্চা, জরদা, সেমাই তো থাকতোই। এ সব দেখতে দেখতেই আমাদের বড় হয়ে ওঠা। মনে আছে কলেজ জীবনে এক পাকা বন্ধু ঈদের দিন একবার আমাদের বাড়িতে এসে খাওয়া-দাওয়া সেরে যাওয়ার আগে আমার মাকে বলেছিল, কলকাতার নিজামের রোল ও নাকি বহুবার খেয়েছে। তাই মা যদি একবার…..? স্পষ্ট মনে আছে আমার মা খুব ঠান্ডা গলায় ওকে বলেছিলেন, তুমি আমাকে অপমান করতে চাইলে কিনা জানি না। বাড়ি ফিরে তোমার মাকে জিজ্ঞাসা করো তুমি কোনও অন্যায় করলে কিনা। মাথা নিচু করে সেদিন ও চলে গিয়েছিল। আমাদের বাড়ি আর কোনওদিন সে আসেনি।

    আজ, জীবনের এই অপরাহ্নবেলায় পৌঁছেও, এই ২০২২-র প্রাক পুজোলগ্নে বসে বিগত অন্যন্য বছরগুলির মতো আমার প্রিয় বান্ধবীর জন্য কেনা শাড়িটা হাতে নিয়ে ভাবছি, হঠাৎ গজিয়ে ওঠা দেশপ্রেমিকরা কি জানে আমার দেওয়া শাড়িটা পরে প্রতিবারের মতো আমার বান্ধবী অষ্টমীর অজ্ঞলি দিতে যাবে? যতদিন বাঁচব আমাদের এই গোপন অঙ্গীকার বেঁচে থাকবে। এর জন্য ঢাকঢোল পিটিয়ে বলতে হয় না আমি খুব উদারচেতা বা আমার বান্ধবী ব্যতিক্রমী চরিত্র। আর এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এমন স্বাভাবিক ঘটনা অনেক আছে। আমাদের চারপাশে শুধু একটু চোখ মেলে দেখা।

 `প্রত্যাশা মতো তাই এখন আর সমাজে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া অসংখ্য অবাঞ্ছিত ঘটনার কোনও প্রতিবাদ হয় না। যাদের প্রতিবাদ করার কথা তাদেরই একটা বড় অংশই যে জড়িয়ে পড়ছে নানা অন্যায়ের সঙ্গে।`

     গত কয়েক দশকে পৃথিবী খুব দ্রুত বদলে গিয়েছে। গ্লোবাল ভিলেজের বাসিন্দা হয়ে আমরা বিশ্বায়নের প্রবল স্রোতে ভেসে চলেছি। কিন্তু কোথায় চলেছি? রণসজ্জায় আমরা এখন পাল্লা দিতে পারি পৃথিবীর বেশকিছু দেশের সঙ্গে। স্যাটেলাইট প্রযুক্তিতে অনেক এগিয়ে গিয়েছি আমরা। নেট দুনিয়ার আনাচে-কানাচে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের ক্ষিপ্র অগ্রগতিতে গর্বিত হয়ে উঠছি নতুন করে প্রতিদিন। আমাদের সন্তানদের প্রযুক্তিনির্ভর করে তোলার জন্য, তাদের সামনে বিপুল ভোগ-ঐশ্বর্যের দুনিয়াটাকে ধরে দেওয়ার জন্য আমরা সর্বস্ব বাজি ধরতেও পিছপা হচ্ছি না। এখন বেঁচে থাকার অর্থই হয়ে উঠছে খাও-পিও-মস্তি বনাও। তার জন্য নার্সারি থেকে শুরু হয় শিশুর প্রশিক্ষণ–আর তা দিতে তৎপর হয়ে উঠি আমরা বাবা-মায়েরাই। আগের দিনে সন্তানের জন্য কামনা ছিল ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’। এখন তা হয়ে দাঁড়িয়েছে সন্তান যেন থাকে ভোগে-সুখে। সেজন্য পড়াশোনার উদ্দেশ্য এখন জ্ঞানার্জন নয়, অর্থোপার্জন। তার ফল ফলতে শুরু করেছেও।

    সবকিছু না হলেও অনেক কিছু  দিয়েও যে নতুন প্রজন্মকে আমরা খুশি করতে কিংবা সুখি করতে পারিনি, তার নিত্য-নতুন উদাহরণ  প্রতিদিন খুব নির্মমভাবে জানতে হচ্ছে আমাদের। বন্ধু, পার্টি, হুল্লোড়, অঢেল মদ্যপানের প্রতিযোগিতা, মেয়ে বন্ধুদের ‘মেয়েশরীর’ হিসেবে দেখার আধুনিকতা অনেকে এতটাই রপ্ত করে ফেলেছে যে, মাদক খাইয়ে বান্ধবীকে অজ্ঞান করে তার সঙ্গে সম্মিলিত যথেচ্চাচারের মহড়া দিতেও অনেকে পিছপা হয় না। উশৃঙ্খলতার কোন পর্যায়ে পৌঁছলে অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা পর্যন্ত ঘটে যায়! আমরা কী দেখলাম? তদন্ত, আলোচনা, সমালোচনা, দোষারোপ, পালটা দোষারোপ, মৃত তরুণের শবব্যবচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গে তার মায়ের চরিত্রের ময়নাতদন্ত কী না ঘটে গেল! এর নাম আধুনিকতা যার দীক্ষা দেওয়া হচ্ছে যুবসমাজকে। সামাজিক মূল্যবোধ, চরিত্রগঠন, দায়িত্ববোধ এ সব বস্তাপচা শব্দগুলিকে কবেই হিমঘরে বিসর্জন দেওয়া হয়ে গিয়েছে! এখন তাই বৃদ্ধ বাবা-মায়ের ঠাঁই হয় বৃদ্ধাবাসে, দাম্পত্য সম্পর্কে বিশ্বাস হারিয়ে নতুন প্রজন্ম ‘লিভ-ইন’-এ বিশ্বাসী হয়ে উঠছে। অর্থাৎ জীবনের কোনও সম্পর্কেই দায়িত্ব নিতে তারা আর রাজি নয়। এমনকি নিজের ব্যাপারেও নয়। নীল তিমির গ্রাসে নিজেকে তুলে দেওয়া তো কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর সলতে পাকানোর কাজ শুরু হয়েছে অনেক আগেই।

    আজকের দুনিয়ায় নাকি ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের জয়-জয়কার। সেই স্বাতন্ত্রবোধ এতখানি প্রবল যে একটি পরিবারে দু’ বা তিনজন সদস্য কেউ কারও ব্যাপারে হস্তক্ষেপ দূরের কথা, খবরও রাখে না। অথচ মজার ব্যাপার এটিই, স্বাধীনভাবে বড় পরিধিতে নিজের অবস্থান, পারিপার্শ্বিকতার ক্ষেত্রে গড্ডলিকায় না মিশে নিজস্ব ভাবনা, বিশেষ করে সমাজ-যান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে চিরকালের যুব সমাজের রুখে দাঁড়ানোর প্রবণতা সবই হারিয়ে গিয়েছে আজকের তরুণ প্রজন্মের ভিতর থেকে। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে অধিকাংশই নিজের নিজের স্বেচ্ছাচারের জগৎ নিয়ে, টাকা আর নেশাকে জীবনের শেষ সত্য মেনে নিয়েছে। এককথায় স্বাধীন চিন্তার জগৎ থেকে সরে এসে অধিকাংশই হয়ে উঠেছে এক-একজন অনুভূতিহীন রোবট। বিশ্বায়নের চতুর খেলায় আমাদের ভবিষ্যতরা অসংখ্য ভ্রান্তির জালে জড়িয়ে পড়ছে। একটা দেশকে শেষ করে দেওয়ার শ্রেষ্ঠ পথ হ’ল তরুণ প্রজন্মকে দিশাহীন করে দেওয়া। সেটাই ঘটে চলেছে। এর পিছনের কারিগর যে কারা, তা বোঝার মতো মেধা বা বুদ্ধির অভাব না থাকলেও তা প্রতিরোধ করার পথটাই সুকৗশলে রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

`ইদানীং ‘সম্প্রীতি’ শব্দটি সমাজমনস্ক মানুষের বোধের জগতে বেদনা জাগিয়ে তুলছে। মানুষ মানুষের এতটাই শত্রু হয়ে উঠেছে যে নরহত্যা অনেকের কাছেই বেশ তৃপ্তিদায়ক একটা বিজয়োৎসবে পরিণত হয়েছে।`

        প্রত্যাশা মতো তাই এখন আর সমাজে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া অসংখ্য অবাঞ্ছিত ঘটনার কোনও প্রতিবাদ হয় না। যাদের প্রতিবাদ করার কথা তাদেরই একটা বড় অংশই যে জড়িয়ে পড়ছে নানা অন্যায়ের সঙ্গে। হয়তো কেউ বলবেন ওদের সামনে কোনও রোল মডেল নেই।  তাদের ভেবে দেখতে বলি দেশের পরাধীনতার ইতিহাস আর তা থেকে মুক্তির সংগ্রামপর্বের  মতো ক্রাইসিস যাঁরা কাটিয়ে আমাদের সামনে স্বাধীন, মুক্ত পৃথিবীটা  ধরে দিয়ে গিয়েছেন, তাঁরাই তো চিরকালের রোল মডেল হয়েই আছেন। সেই মুক্ত হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিয়ে আমরা যে কী প্রতিদান দিচ্ছি, তা নিয়ে একবার ভেবে দেখবেন না?

    সত্যিই কি আমরা একবারও ভেবে দেখেছি প্রকৃত অর্থে আমরা কতটা স্বাধীন? আমাদের মানসিক মুক্তি  আদৌ ঘটেছে কি? অসংখ্য গুরুবাবারা যেভাবে তাদের প্রতিপত্তি বাড়িয়ে চলেছে, নতুন প্রজন্মের একটা বড় অংশ প্রশ্নহীন আনুগত্যে যেভাবে তাদের পায়ে দলে দলে নতজানু হচ্ছে,জাতপাত, শুভ-অশুভের বিচারের নামে মানুষকে একঘরে করা, ডাইনি সাব্যস্ত করে কাউকে মৃত্যদণ্ডের নিদান দেওয়া–পৃথিবীর অগ্রগতির পাশাপাশি এইসব ঘটনা দিন দিন যেন বেড়েই চলেছে। মানুষের সমস্ত চিন্তা-ভাবনায় এতটাই স্থবিরত্ব এসে গিয়েছে! অনুভূতি এতটাই ভোঁতা হয়ে গিয়েছে যে ইদানীং রাস্তায় দুর্ঘটনার কবলে পড়া মুমূর্ষু  মানুষের একটু জলের জন্য কাতর আর্তনাদকে আমল না দিয়ে তার সঙ্গে সেলফি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে অনেকেই। সহযাত্রীর হঠাৎ বিপদকে অনেকেই মোবাইল গেমের সঙ্গে একাকার করে ফেলে বোধহয়।

    ইদানীং ‘সম্প্রীতি’ শব্দটি সমাজমনস্ক মানুষের বোধের জগতে বেদনা জাগিয়ে তুলছে। মানুষ মানুষের এতটাই শত্রু হয়ে উঠেছে যে নরহত্যা অনেকের কাছেই বেশ তৃপ্তিদায়ক একটা বিজয়োৎসবে পরিণত হয়েছে। শুধু একটা উপলক্ষ চাই, তা সে যত তুচ্ছই হোক না। একটা মোবাইল ফোনের জন্য বাবাকে ছেলে হত্যা করছে, দাদা সম্পত্তির লোভে অনায়াসে খুন করছে ভাইকে, বাড়ি দখলের জন্য বৃদ্ধ অসহায় বাবা-মাকে রাস্তায় বের করে দিচ্ছে–সভ্য সমাজের এই ছবিই তো দিনে দিনে প্রকট হয়ে উঠছে। আদালত এখন পারিবারিক ব্যাপারে  হস্তক্ষেপ না করলে সমস্যার সমাধান হয় না। সম্প্রীতি কি আমাদের পরিবারগুলিতে আছে? রক্তের সম্পর্কের ক্ষেত্রেই দূরত্ব বাড়তে বাড়তে রন্ধ্রপথে ঢুকে আসছে হিংসার বীজ। সেই পরিবারভুক্ত মানুষ কীভাবে ভালবাসবে তার প্রতিবেশীদের? সুবিধাবাদী যেসব চিন্তা পূর্বপুরুষরা নিজেদের মধ্যে যুগ যুগ ধরে লালন করে এসেছে, সন্তানের মধ্যে ছেলেবেলা থেকেই যা সংক্রামিত হয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে এসে মনুষ্যত্ব অর্জনের কষ্টকর পথে সে কেন হাঁটবে? তাই জাতপাতের কুৎসিত বিচার আচার আমাদের শুধু দুর্বল করেই দেয়নি, তা আমাদের শক্তিশালী একটি জাতি হিসেবে গড়ে ওঠার পথে প্রাচীর তুলে দিয়েছে।

    আসলে আমরা তথাকথিত শিক্ষিত, সংস্কৃতিমান বলে যারা নিজেদের দাবি করি, বিশ্বাস করি  ঔদার্যে, তারাও কিন্তু অনেকেই নিজেদের অজান্তে  মনের গভীরে লালন করে চলেছি ভয়ংকর বিষাক্ত এক বাস্তুসাপকে যাকে কেউ বলেন সাম্প্রদায়িকতা, কেউ বলেন প্রাদেশিকতা, কেউ বলেন বিচ্ছিন্নতাবোধ। সেই কারণেই গ্রামের সাতটি কুয়োর জল বরাদ্দ তথাকথিত উঁচু জাতের জন্য, একটি দলিতদের। তাতেও বিষ ঢালার জন্য বন্দুকবাজকে পাঠানো হয়েছে এ খবর সংবাদপত্রের গুরুত্বহীন অংশে ছাপা হতে দেখেছি আমরা। সমস্যাটা এই মুহূর্তে দুটি ধর্ম সম্প্রদায়ের বিরোধ, দাঙ্গা, সম্পত্তি বা দু’-চারটে প্রাণহানিতে সীমাবদ্ধ থাকলেও এর শিকড় অনেক গভীরে। সে আলোচনা স্বল্প পরিসরে, এই প্রেক্ষাপটে করা সমীচীন হবে না। কেননা তাতে সমাধানের পথ যতটা না বেরিয়ে আসবে, অনেকেরই ভুল বোঝার সম্ভাবনা তৈরি হবে। খুব সহজ একটা  জিজ্ঞাসা নিজের কাছে তথা সবার কাছে রাখা যেতে পারে। কোনও নির্দিষ্ট ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়ের উল্লেখ না করে প্রশ্নটা করা যেতে পারে–আমরা যাদের সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ তাদের কারও দ্বারা কি সরাসরি আমি বা আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি কখনও? ভুল ইতিহাস অথবা ইতিহাসের সুকৌশলী অপব্যাখ্যা দ্বারা আমরা ভুল শিক্ষায় চালিত হচ্ছি না তো? এই পৃথিবীর জল, হাওয়া, আকাশ আর জীবন সৃষ্টি কি আমার হাত ধরে হয়েছে? তা না হলে আমার কী অধিকার আছে অন্যকে ছোট ভাবার? শত্রু ভাবার? অন্যের প্রাণ সংহার করার? সম্প্রদায় বিশেষকে ঘৃণা করার?

    মানুষ হওয়ার বেশ কিছু শর্ত রয়েছে বলেই মানুষকে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি বলা হয়। সেই কারণেই আমাদের কিছু দায়িত্ব থেকে যায় মানুষের প্রতি, মনুষ্যেতর জীবদের প্রতি, এই পৃথিবীকে বাসযোগ্য করার প্রতি এমনকি স্বয়ং ঈশ্বরের প্রতিও। আর এগুলি তখনই পালন করা সম্ভব যখন নিজেকে ছাড়িয়ে ভালবাসার বৃত্তটা প্রসারিত হয় অনেকখানি। সহানুভূতি আর একটু ভালোবাসা সুন্দর করে তুলতে পারে আমাদের চারপাশ। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়–‘আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া / বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া’।

    কাজেই আজ আর ঘুমিয়ে থাকার দিন নয়। ভাবনা বদলের দিন। আমাদের অজান্তে চুরি হয়ে যাচ্ছে আমাদের সন্তানের মনুষ্যত্ব। আমাদের স্বার্থপরতাই ডেকে আনছে অনেক রকম অন্ধকার। মানুষের একমাত্র আশ্রয়স্থল এই সুন্দর পৃথিবীটাকে আমরা নষ্ট করে চলেছি প্রতিদিন। মনেপ্রাণে বিশ্বাস করার সঙ্গে সঙ্গে আজ  বারবার উচ্চারণ করা দরকার– আমাদের ‘‘Birth place: Earth/ Race: human/Politics: Freedom./ Religion: Love.’’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here