উঁকি দিচ্ছে পেঁজা মেঘের স্তূপ। ছাতিম ফুলের গন্ধ, কাশের হিল্লোল আর বকুলে ছেয়ে যাওয়া গাছে তার আবাহনী সুর। লিখছেন সফিউন্নিসা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর পরিচয় গ্রন্থের ‘শরৎ’ প্রবন্ধে লিখেছেন— ইংরেজের সাহিত্যে শরৎ প্রৌঢ়। তার যৌবনের টান সবটা আলগা হয় নাই, ও দিকে তাকে মরণের টান ধরিয়াছে, এখনো সব শুকিয়া যায় নাই কেবল সব ঝরিয়া যাইতেছে। …. কিন্তু এ শরৎ আমাদের শরৎ একেবারেই নয়, আমাদের শরতের নীল চোখের পাতা দেউলে হওয়া যৌবনের চোখের জলে ভিজিয়া ওঠে নাই। আমার কাছে আমাদের শরৎ শিশুর মূর্তি ধরিয়া আসে। সে একেবারে নবীন। বর্ষার গর্ভ হইতে এইমাত্র জন্ম লইয়া ধরণী-ধাত্রীর কোলে শুইয়া সে হাসিতেছে।
তার কাঁচা দেহখানি; সকালে শিউলি ফুলের গন্ধটি সেই কচিগায়ের গন্ধের মতো। আকাশে আলোকে গাছেপালায় যা কিছু রং দেখিতেছি, সে তো প্রাণেরই রং, একেবারে তাজা।…. তাহা কাঁচা, বড় নরম। রৌদ্রটি কাঁচা সোনা, সবুজটি কচি, নীলটি তাজা। এইজন্য শরতে নাড়া দেয় আমাদের প্রাণকে…..শরতের হাসি-কান্না কেবল আমাদের প্রাণপ্রবাহের উপরে ঝিকিমিকি করিতে থাকে, যেখানে আমাদের দীর্ঘশ্বাসের বাসা, সেই গভীরে গিয়া সে আটকা পড়ে না। তাই দেখি শরতের রৌদ্রের দিকে তাকাইয়া মনটা কেবল চলি চলি করে …..শরৎ বড় বড় গাছের ঋতু নয়, শরৎ ফসল খেতের ঋতু। এই ফসলের খেত একেবারে মাটির কোলের জিনিস। আজ মাটির যত আদর সেইখানেই হিল্লোলিত….. মাটির কন্যার আগমনীর গান এই তো সেদিন বাজিল। মেঘের নন্দীভৃঙ্গী শিঙা বাজাইতে বাজাইতে গৌরী শারদাকে ধরণী-জননীর কোলে রাখিয়া গিয়াছে।
সত্যিই শরৎ এসেছে। অকাল বাদলবেলাতেও তার মেঘের রং ঘন নীল। উঁকি দিচ্ছে পেঁজা মেঘের স্তূপ। ছাতিম ফুলের গন্ধ, কাশের হিল্লোল আর বকুলে ছেয়ে যাওয়া গাছে তার আবাহনী সুর বাজছে। এই সময়টায় অনুভূতিশীল মানুষের মন বলে ‘পালাই পালাই’। আলোর ভেরি বেজে ওঠার অপেক্ষা, তারপরই তল্পিতল্পা বেঁধে বাঙালির বেরিয়ে পড়া, এ চলছে সেই শতাব্দীপ্রাচীন বাঙালিয়ানার মজলিশি সময় থেকেই। যুগের পরিবর্তনে শুধু তার বাহ্যিক চেহারাটাই বদলেছে।
করোনাবিধি ঠিকমতো মেনে অনায়াসে আনন্দের স্বাদ নেওয়া যায়; হয় তো তা অতীতের মতো লাগামহীন হবে না। হয় তো প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘুরে বাঁধনহীন খুশিতে ভেসে যাওয়া হবে না। তবু আমরা যেভাবে করোনাকালীন ‘নিউ নর্মাল’ লাইফ মেনে নিয়েছি, সেইভাবেই নিউ নর্মাল আনন্দে ভাসতে অসুবিধা কোথায়?
আম বাঙালির এই অকৃত্রিম শখ-আহ্লাদে গত দু’বছর ধরে কালি ঢেলে চলেছে এক বিদঘুটে পৃথিবীব্যাপী মহামারি ‘কোভিড’, যার নামটাও জানা ছিল না কারও। আনন্দহীন নিষ্প্রাণ পুজোর আয়োজনে সেই উচ্ছ্বাস-উদ্দামতা কোথায় হারিয়ে গিয়েছে। গত পুজোয় বিধি-নিষেধের বেড়াজালে তবু মানুষ বেরিয়ে পড়েছিল ভয়ে ভয়ে। এ বারও আদালতের রায়ে মানতে হবে কড়া নিয়ম-কানুন। লাগামছাড়া মন দমে যায়; পথ খোঁজে ভিন্নতায়। শোনা গেল মন্দারমণির হোটেল-রিসর্টগুলিতে তিল ধারণের জায়গা থাকবে না। সব বুকিং শেষ। দিঘাও তথৈবচ। ভিনরাজ্যের পথেও অনেকে যাত্রার উদ্যোগ নিয়েছেন। আর কলকাতার পুজোর উদ্যোক্তারা উঠে পড়ে লেগেছেন নিয়মের ঘেরাটোপের মধ্যেও সর্বাধিক কতটা আনন্দের আয়োজন করা যায় তার প্ল্যানিং করতে।
কারণ, আকাশ-বাতাস-গাছ-পাখি—প্রকৃতির সন্তানদের কাছে বার্তা এসেছে সঠিক সময়ে। তাদের কাছে উৎসবের সূচনা ঘটে গিয়েছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। কোভিডের চোখ রাঙানিকে তারা ডরায় না। আর আমরা প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি বলে দাবি করা মনুষ্যকুল শুধু ভুগে চলেছি বিপন্নতায়, আতঙ্কে। অথচ, একটু সাবধান আর সতর্ক হলেই কিন্তু বিপদ এড়ানো সম্ভব। করোনাবিধি ঠিকমতো মেনে অনায়াসে আনন্দের স্বাদ নেওয়া যায়; হয় তো তা অতীতের মতো লাগামহীন হবে না। হয় তো প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘুরে বাঁধনহীন খুশিতে ভেসে যাওয়া হবে না। তবু আমরা যেভাবে করোনাকালীন ‘নিউ নর্মাল’ লাইফ মেনে নিয়েছি, সেইভাবেই নিউ নর্মাল আনন্দে ভাসতে অসুবিধা কোথায়?
আনন্দলাভ যদি উৎসবের মূল উদ্দেশ্য হয়, তবে তা নানাভাবেই লাভ করা সম্ভব। মানুষই পারে সমুদ্র মন্থন করে অনন্ত অমৃতানন্দ লাভ করার জন্য অজানায় ভেসে যেতে, মানুষই পারে সীমা স্বর্গের ইন্দ্রাণীর কাছে অফুরন্ত আনন্দের ভাণ্ডার খুঁজে নিতে। আজ এই আনন্দঘন সময়ে বাঙালি সীমাস্বর্গেই না হয় খুঁজে নিক এ বারের শারদোৎসবের যাবতীয় খুশির পারিজাত। মগ্ন থাকুক তার রূপ-রস-গন্ধে।