শেষ রক্ষা হবে তো !

নরেন্দ্র মোদী এবং কৃষক আন্দোলন। ছবি–সংগৃহীত।

পুলক দেবনাথ

গামী বছরের গোড়ায় উত্তরপ্রদেশ, পঞ্জাব-সহ পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোটের দিকে তাকিয়ে যে প্রধানমন্ত্রী তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করেছেন, তা এখন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। ধাক্কা না খেলে শাসক দলগুলির কিছুতেই সম্বিত ফেরে না। গত এক বছর ধরে কৃষক আন্দোলন হয়ে আসছে ওই তিনটি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে। কিন্তু এই সেদিন পর্যন্তও কেন্দ্রের মোদী সরকার তাদের অবস্থানে গোঁ ধরে ছিল। তাদের বক্তব্য ছিল, তিনটি আইনই কৃষকদের স্বার্থ রক্ষা করবে। অতএব কৃষি আইন প্রত্যাহারের প্রশ্নই নেই। বরং প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে কৃষক নেতাদের ‘আন্দোলনজীবী’ বলে কটাক্ষ করেছিলেন। পেট্রল-ডিজেলের ধারাবাহিক মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে বিরোধীরা গলা ফাটালেও তাকে পাত্তা দেয়নি মোদী সরকার। পেট্রল ও ডিজেল দু’টি জ্বালানি তেলই লিটার প্রতি একশো টাকার গণ্ডি ছাড়িয়ে গেলেও কেন্দ্র এমন একটা গোবেচারা ভাব করছিল যেন তাদের কিছুই করার নেই!

    কিন্তু সাম্প্রতিক তিরিশটি কেন্দ্রের উপ-নির্বাচনে বিজেপির ফল খারাপ হতেই চোখ খুলে গেল নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ, জগৎপ্রকাশ নাড্ডাদের। ফলে দেওয়ালের লিখন পড়তে তাঁদের অসুবিধা হল না। সামনের দিনগুলিতে বিপদের সংকেত! জনমত সমীক্ষাতেও সামনের বিধানসভা নির্বাচনগুলিতেও ধাক্কা খাওয়ার পূর্বাভাস। তাই আর চুপচাপ হাত গুটিয়ে বসে থাকা যায় না। কৃষক আন্দোলনের দাপটে পঞ্জাবে আশা নেই! এর সঙ্গে যদি উত্তরপ্রদেশও হাতছাড়া হয়ে যায়, তা হলে তো দু’হাজার চব্বিশের লোকসভা ভোটের লড়াইটাও কঠিন হয়ে যেতে পারে! তাই আর দেরি না করে কেন্দ্র প্রথমে পেট্রল ও ডিজেলের উপর থেকে উৎপাদন শুল্ক কমাল। উত্তরপ্রদেশ-সহ বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিকেও ভ্যাট কমাতে বলা হল। এরপর তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার করে কৃষকদের ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা হল। লক্ষণীয়, পঞ্জাবের দিকে তাকিয়ে এই ঘোষণার জন্য গুরু নানকের জন্মদিনটিকে বেছে নেওয়া হল। এর পিছনে পঞ্জাবের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা কংগ্রেসত্যাগী নেতা ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংয়ের হাত আছে বলে অনেকে মনে করছেন। আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে পঞ্জাবে পায়ের তলার মাটি শক্ত করতে বিজেপি নেতৃত্ব তাঁর হাত ধরতে চাইছেন বলে খবর। তিনিই নাকি কৃষি আইন প্রত্যাহার করে কুশলী চাল দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন মোদী-শাহদের!

 সিঙ্গুর আন্দোলনে যবনিকা পড়েছিল। কিন্তু তাতে বামেদের পালে হাওয়া লাগেনি। দু’হাজার এগারো সালের বিধানসভা নির্বাচনে অনায়াসে বামেদের চৌত্রিশ বছরের শাসনের অবসান ঘটিয়ে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে মা-মাটি মানুষে সরকার গঠিত হয়।

    কিন্তু এতসব করেও কি বিজেপি পঞ্জাব ও উত্তরপ্রদেশে খেলা ঘোরানো যাবে? এটাই এখন বড় প্রশ্ন। সাম্প্রতিক নির্বাচনে পঞ্জাবে তারা বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি। উত্তরপ্রদেশেও দু’হাজার সতেরো সালের সময়ের সেই শক্তি বিজেপির নেই। সাম্প্রতিক পঞ্চায়েত নির্বাচনে জোর টক্কর হয়েছে। উত্তরপ্রদেশে বিজেপির ভরসা কেবল বিরোধীদের অনৈক্য। সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজ পার্টি ও কংগ্রেস তিন পৃথক মেরুতে অবস্থান করছে। কিন্তু কৃষক আন্দোলনের সুবাদে সেখানকার জাঠ সম্প্রদায় বিজেপির ওপর বেজায় ক্ষুব্ধ। বিশেষত লখিমপুরে যেভাবে আন্দোলনকারী কৃষকদের পিষে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে, তাতে বিব্রত বিজেপি নেতৃত্ব। এই ঘটনায় অভিযুক্ত হয়েছেন খোদ বিজেপি নেতা তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অজয় মিশ্র ও তাঁর ছেলে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই ঘটনা নিয়ে একটিও বাক্য খরচ না করায় মানুষের মনে ক্ষোভ জাগা স্বাভাবিক। তাই তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার করলেই যে এই ক্ষোভ দূর করা যাবে, তা হয়তো সম্ভব নয়।

    এ প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে সিঙ্গুর আন্দোলনের কথা এসে যায়। এই আন্দোলনে কীভাবে চৌত্রিশ বছরের বাম সরকারকে লেজেগোবরে হতে হয়, তা তো এখন ইতিহাস। রাজভবনে রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধী ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে শুষ্ক মুখে বিধ্বস্ত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর মুখটি ভেসে ওঠে আজও। ত্রিপাক্ষিক বৈঠক করেও অনিচ্ছুক চাষিদের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করা যায়নি। অবশেষে টাটাদের সিঙ্গুরের উর্বর জমি থেকে পাততাড়ি গোটানোর ঘোষণা করতে হয়েছে। আর বুদ্ধদেববাবুদের তা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। সিঙ্গুর আন্দোলনে যবনিকা পড়েছিল। কিন্তু তাতে বামেদের পালে হাওয়া লাগেনি। দু’হাজার এগারো সালের বিধানসভা নির্বাচনে অনায়াসে বামেদের চৌত্রিশ বছরের শাসনের অবসান ঘটিয়ে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে মা-মাটি মানুষে সরকার গঠিত হয়।

    সে দিনও কৃষকের জয় হয়েছে। আজও তাই। কাজেই তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার করলেই যে বিজেপি তাদের পালে হাওয়া ঘোরাতে পারবে, তার নিশ্চয়তা কোথায়? যেভাবে ক্ষমা চেয়ে নরেন্দ্র মোদী আইনগুলি প্রত্যাহার করেছেন, তাতে জনমানসে পরাজয়ের বার্তা গিয়েছে। কী পেট্রল-ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি, কী কৃষি আইন, কী অতিমারি মোকাবিলায় ব্যর্থতা, বহু মানুষের মনে এই ধারণা তৈরি করেছে, ভুল পথে ছিল মোদী সরকার তথা বিজেপি। আসন্ন বিধানসভা ভোটে তার প্রতিফলন ঘটতেই পারে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here