সততার গায়ে কেউ কালি ছেটালে তিনি কাউকে রেয়াত করবেন না। তৃণমূলনেত্রী তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গলা চড়িয়ে এই হুঁশিয়ারি দিতেই পারেন। তাতে বিরোধীরা আরও বেশি করে লম্ফঝম্ফ শুরু করেছেন। আসলে এই হল রাজনীতি। নেত্রী যখন বিরোধী দলে ছিলেন, তখন একইভাবে শাসকদলকে তুলোধোনা করেছেন। ক্ষমতায় এসেও বিরোধীদের ছেড়ে কথা বলছেন না। বলছেন–অযথা আমার গায়ে কালি ছেটানো হলে আমি ছেড়ে কথা বলব না। আমার হাতেও আলকাতরা রয়েছে। সেই আলকাতরা তিনি আদৌ ছুড়বেন কিনা, তা সময়ই বলবে। তার আগে নিয়োগ-দুর্নীতি নিয়ে রাজ্য-রাজনীতি সরগরম। দুর্নীতি-মামলায় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার হেফাজতে রয়েছেন রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তিনি শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালীন রাজ্যে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে চরম দুর্নীতি হয়েছে বলে বিস্তর অভিযোগ। তদন্তে নেমে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) মন্ত্রীর বাড়ি থেকে তল্লাশি চালিয়ে বেশকিছু নথি সংগ্রহ করেছে। পাশাপাশি তাঁর ঘনিষ্ঠ অভিনেত্রী অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের টালিগঞ্জ ও বেলঘরিয়ার ফ্ল্যাটে হানা দিয়ে প্রায় ৫০ কোটি টাকা বাজেয়াপ্ত করেছে। উদ্ধার হয়েছে একাধিক জমি ও বাড়ির দলিল, প্রচুর সোনা-রুপোর গয়না, বিদেশি মুদ্রা। আরও কত টাকা ও সম্পত্তির হদিশ মিলবে, তা নিয়ে জল্পনার শেষ নেই। কারণ, তদন্ত চলছে। তদন্তে রাজ্য শিক্ষা দফতরের প্রশাসনিক আধিকারিকদের মধ্যে কয়েকজনকে ইডির আধিকারিকরা জেরা করছেন। এই তদন্ত সঠিকভাবে এগলে দুর্নীতির শিকড় কোথায় গিয়ে ঠেকেছে, তা বেরিয়ে আসাটাই স্বাভাবিক।
মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন–আমি চাই, সত্য সামনে আসুক। সত্য প্রমাণ হলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিন। আমার কোনও আপত্তি নেই। তবে আমার ছবির সঙ্গে টাকার পাহাড়ের ছবি দিয়ে কুৎসা রটাচ্ছে বিরোধীরা। কয়েকটি রাজনৈতিক দলের আচরণে আমি সত্যিই দুঃখিত। আমি পুজোয় যাই। অর্গানাইজাররা যদি কাউকে স্টেজে আগে থেকে ডেকে রাখে, তাতে আমি কী করতে পারি। তার মানে আমি পুজো প্যান্ডেলে যাব না? যদি কেউ চোর হয়, ডাকাত হয়, তৃণমূল রেয়াত করবে না। কিন্তু অযথা আমার গায়ে কালি ছেটানো হলে আমি ছেড়ে কথা বলব না। আমার হাতেও আলকাতরা রয়েছে। বিরোধীদের দাবি, শিক্ষক দুর্নীতি-মামলা এখন কেলেঙ্কারিতে পরিণত হয়েছে। সেই কেলেঙ্কারি ঢাকতে মুখ্যমন্ত্রী যে হুঁশিয়ারি-ই দিন না কেন, ইডির তদন্তে যে ভাবে টাকার পাহাড় বেরিয়ে আসছে, তাতে আক্ষরিক অর্থেই অস্বস্তিতে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা-নেত্রীরা। আসলে পার্থ চট্টোপাধ্যায় শুধু মন্ত্রী নন, তৃণমূল কংগ্রেসের মহাসচিব, শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির পদাধিকারী ছিলেন। দুর্নীতির অভিযোগে তিনি ইডির হেফাজতে। তিনি একাই নন, তাঁর ঘনিষ্ঠ অভিনেত্রী-সহ আরও কয়েকজন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার হেফাজতে। তদন্তের জাল সেই সংস্থা যেভাবে গুটিয়ে আনতে উদ্যোগী হয়েছে, তাতে আরও রাঘববোয়াল যে ধরা পড়বে না, তা হলফ করে এখনই বলা যাচ্ছে না। এই পরিপ্রেক্ষিতে ড্যামেজ কন্ট্রোলে নামাটাই সমীচীন বলে মনে করে তৃণমূলের তরফে পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে দল থেকে বহিষ্কারের দাবি করে টুইট করেন দলেরই রাজ্য সম্পাদক কুণাল ঘোষ। কয়েকদিন আগেই তিনি বলেছিলেন, মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগে আদালতের সিলমোহর পড়লে দল ব্যবস্থা নিতে কুণ্ঠিত হবে না। তাঁর মুখেই আবার উলটো সুর। সেই সুর তৃণমূলের অন্দরের সমীকরণকে উসকে দিচ্ছে। কারণ, গত ২১ জুলাইয়ের সভায় প্রকাশ্যেই তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছিলেন–এটা অন্য তৃণমূল। সেই ‘অন্য’ তৃণমূল গঠনের লক্ষ্যেই, নাকি বিরোধীদের প্রবল চাপের মুখে পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে দলের অবস্থান বদল করতে হল, তা নিয়ে রাজনৈতিক এবং অরাজনৈতিক মহলে চলছে জোর চর্চা।
ইতিমধ্যে, মুখ্যমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে মন্ত্রিত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। দল থেকেও তাঁকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। এ ভাবে দলের ভাবমূর্তি ফেরাতে মরিয়া তৃণমূল নেতৃত্ব কি পারবেন পাহাড়-প্রমাণ ‘দুর্নীতি’র পাঁক থেকে অন্য তৃণমূলকে বঙ্গবাসীর কাছে তুলে ধরতে, সেটাই দেখার।