মমতার জয় এবং ভবিষ্যৎ

প্রচার-ছবি–সংগৃহীত

কুশের ভোট আর উপ-নির্বাচন আলাদা। নন্দীগ্রাম আর মমতার ঘরের মাঠ ভবানীপুরও এক নয়। রায় দিল ভবানীপুর। আসলে নন্দীগ্রামে ভোট হয়েছিল তৃণমূল বনাম বিজেপির নয়। ভোট হয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বনাম শুভেন্দু অধিকারির। সেই ভোটে শুভেন্দুর কাছে মমতাকে হার মানতে হয়েছে। যদিও মমতা এই হার মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেননি। তাই তিনি আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। উপ-নির্বাচনে মমতার এই ক্ষতে প্রলেপ দিল ভবানীপুর।

    শুধু জেতাই নয়, নিজেই নিজের রেকর্ড ভেঙেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভবানীপুর উপনির্বাচনে ৫৮ হাজার ৮৩৫ ভোটে তিনি জয়ী হয়েছেন। সেই সঙ্গে জয়ের হ্যাটট্রিকও করলেন তিনি। এক দিকে যেমন মমতা নিজের জয়ের রেকর্ড ভেঙেছেন, তেমনই এই কেন্দ্রের সব ওয়ার্ডেই তৃণমূল জিতেছে বলে দাবি করেছেন মমতা। আর এর জন্য ভবানীপুরের মানুষের কাছে কৃতজ্ঞতাও স্বীকার করেছেন তিনি।

    মমতা জিতবেন, তা নিশ্চিত ছিলই। কিন্তু কত ব্যবধানে তিনি জিতবেন সে দিকেই নজর ছিল সব রাজনৈতিক দলগুলির। তাই ভোট গণনার দিন সকাল থেকেই গোটা দেশের নজর ছিল ভবানীপুর কেন্দ্রের দিকে। গণনার শুরু থেকেই এগিয়ে ছিলেন মমতা। গণনা যত এগিয়েছে বিজেপি প্রার্থী প্রিয়ঙ্কা টিবরেওয়ালের থেকে তাঁর ভোটের ব্যবধান তত বেড়েছে। ২১ রাউন্ড শেষে বিশাল ভোটে জয় পান তৃণমূল নেত্রী। তাঁর প্রাপ্ত ভোট ৮৫ হাজার ২৬৩। প্রাপ্ত ভোটের হার ৭১.৯১ শতাংশ। সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বিজেপি-র প্রিয়ঙ্কা পেয়েছেন ২৬ হাজার ৪২৮ ভোট। তাঁর প্রাপ্ত ভোটের হার ২২.২৯ শতাংশ। সিপিএমের শ্রীজীব বিশ্বাস পেয়েছেন ৪ হাজার ২২৬ ভোট।

    ভবানীপুর কিংবা মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর ও শমসেরগঞ্জে খাতা খোলার আশাও ছিল না বামেদের। আমরা ২৩৫, ওরা ৩০–বছর ১৫ আগে এমনটা বলেছিলেন বাম মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। কিন্তু বর্তমান বিধানসভায় তাঁদের হয়ে ‘আমরা’ বলার কেউ নেই। রবিবারের ফল ঘোষণার পরে দেখা গেল, এখনও পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভবনে ‘আমি বাম’ বলার মতো কেউ নেই। স্বাধীন ভারতে প্রথমবার। এত কম ভোট পাওয়ার কথা কি ভাবতেই পারেনি সিপিএম? প্রার্থী দেওয়ার সিদ্ধান্ত কি ঠিক ছিল? দলের নেতা রবীন দেব বলেন, ‘‘সবে মাত্র বিধানসভা নির্বাচনে বিপর্যয় হয়েছে। এই অল্প সময়ে বিপর্যয় সামলানো যায় না। তবে এত খারাপ ফল হবে, সেটা আমরা প্রত্যাশা করিনি। মুখ্যমন্ত্রীর ভোটে মুখ্যসচিব, পুলিশ-প্রশাসন যে নির্লজ্জ ভাবে নেমেছিল, তা আমাদের ভাবনায় ছিল না। আর তৃণমূলের ভ্রান্ত নীতির বিরুদ্ধেই তো আমাদের লড়াই। সেই প্রতিবাদটা বোঝাতেই তো আমরা প্রার্থী দিয়েছিলাম।’’ এ নিয়ে তৃণমূল নেতাদের দাবি–নাচতে না জানলে উঠুন বাঁকা। যদিও উপ-নির্বাচনে ব্যতিক্রমী ফল হবে বলে মনে করেননি বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু। তাঁর কথায়, ‘‘ভোটের হার বিশাল বাড়বে এটাও ভাবিনি।’’ একইসঙ্গে ভবানীপুরে ভোটের হার কম নিয়েও তিনি বলেন, ‘‘এ কথা ঠিক কিছু মানুষ ভোট দেয়নি। কেন দিল না, তা জানি না। আর অন্যান্য জায়গায় ভোট ভালোই হয়েছে। সেখানেও যা হওয়ার তাই হয়েছে।’’

    কাজেই ফলাফল যে এমন-ই হবে, তা বামেদের কাছে প্রত্যাশিত-ই ছিল। আর সিপিএমের এমন হার নিয়ে কংগ্রেসের প্রাক্তন প্রদেশ সভাপতি তথা সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্যের প্রতিক্রিয়া, ‘‘সিপিএমের ফল এত খারাপ হবে, তা আমরাও ভাবিনি। তবে আমরা প্রার্থী দিলে হয় তো এর চেয়ে বেশি ভোট পেতাম। সামশেরগঞ্জে, কংগ্রেস ও সিপিএম দুই দলেরই প্রার্থী ছিল। আমরা ৩০ হাজারেরও বেশি ভোট পেয়েছি, সেখানে সিপিএম পেয়েছে হাজার ছয়েক ভোট। এটাই প্রমাণ করে যে, আমরা এখনও রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক।’’ ভবানীপুরে সিপিএম জিতবে এমন আশা না করলেও কোন জায়গায় থাকবে, তা নিয়ে আশঙ্কা ছিল আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের। তবে শেষ পর্যন্ত তৃতীয় হয়ে মুখ রক্ষা হয়েছে। কিন্তু জমানত রক্ষা করতে পারেননি সিপিএম প্রার্থী। ভবানীপুরের সঙ্গে জঙ্গিপুর এবং সামশেরগঞ্জেও জামানত বাজেয়াপ্ত করেই তৃতীয় এবং চতুর্থ স্থানে রয়েছেন বামপ্রার্থীরা। মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুরে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপির সুজিত দাসকে প্রায় ৯৪ হাজার ভোটে হারিয়েছেন তৃণমূল প্রার্থী জাকির হোসেন। এই আসনে বামফ্রন্টের প্রার্থী হয়েছিলেন আরএসপি-র জানে আলম মিয়াঁ। ভোট প্রাপ্তির হিসেবে ৫ অঙ্ক পেরোতে পারেননি তিনি। তাঁর প্রাপ্ত ভোট ৯০৬৭, ভোটপ্রাপ্তির শতাংশ ৪.৫৭। কংগ্রেস সাংসদ অধীর চৌধুরির গড় হলেও মুর্শিদাবাদের এই আসনে প্রার্থী দেয়নি কংগ্রেস। যদিও সূত্র বলছে, বামেদের সঙ্গে আগের সমঝোতার ভিত্তিতেই এই আসন ছেড়েছে প্রদেশ কংগ্রেস।

    মুর্শিদাবাদে অপর একটি আসন সামশেরগঞ্জে জয় পেয়েছেন তৃণমূল প্রার্থী আমিরুল ইসলাম। তিনি ২৬ হাজারের বেশি ভোটে হারিয়েছেন নিকটতম প্রার্থী কংগ্রেসের জইদুর রহমানকে। এই আসনে আবার চতুর্থ স্থানে বামেরা। সিপিএম প্রার্থী মোদাসসর হোসেনের প্রাপ্ত ভোট ৬ হাজার ১৫৮, শতাংশের বিচারে ভোটপ্রাপ্তি ৩.২৭। সিপিএম-র থেকে এগিয়ে রয়েছেন বিজেপির মিলন ঘোষ। তিনি মোট ১০ হাজার ৮০০ ভোট পেয়েছেন। অর্থাৎ তিনি রয়েছেন তিন নম্বরে। অতএব মুর্শিদাবাদে জয় না পেলেও রক্ষিত কংগ্রেস গড়। তিনটি আসনের মধ্যে একটি আসনে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে হাত। আর তিনটি আসনেই জামানত বাজেয়াপ্ত বামেদের।

    তা হলে বঙ্গ রাজনীতিতে তলানিতে আসা বামেদের ঘুরে দাঁড়ানোর দাওয়াই কী? তা নিয়ে কার্যত দিশাহারা বামপন্থীরা। তাঁদের কি সেই কৌটো নাচানোর যুগে ফিরে যেতে হবে? কিন্তু সেই যুগ এখন নেই। বদলের হাওয়ায় শুধু বামেদের গড় নয়, কংগ্রেস-ও কার্যত ধরাশায়ী। আসলে ইতিহাস থেমে থাকে না। অতীতে যে সিপিএম রাজ্য সরকারি কর্মচারী সংগঠনের কাঁধে ভর করে রাজত্ব করেছে, যেটাই ছিল তাদের নিয়তি। সরকারের সবস্তরে দুর্নীতি বাসা বাঁধে। স্বজনপোষণের রাজনীতির বিরুদ্ধে বঙ্গে নিঃশব্দ বিপ্লব ঘটে যায়। টানা ৩৪ বছরের বামশাসনের অবসান হয়।

    কিন্তু বঙ্গবাসীর প্রত্যাশা কি পূরণ হয়েছে? ‘সোনার বাংলা’ গড়তে বিজেপি ২১শের বিধানসভা ভোটে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। কিন্তু বঙ্গের ভোটাররা গেরুয়া শিবিরকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। তাই তাঁরা এখনও মমতাতেই আস্থা রাখছেন। কিন্তু মমতা যেন ভুলে না যান এই আস্থা কিন্তু পদ্মপাতায় জলের মতই টলমল। সবুজসাথি থেকে কন্যাশ্রী, স্বাস্থ্যসাথি থেকে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার–২১শের ভোট পার করে দিলেও বেকার ছেলে-মেয়েরা যদি কর্মসংস্থানের সুযোগ না পান, তাঁরা যদি বেকারত্বের জ্বালায় ভুগতেই থাকেন, তা হলে আগামি প্রজন্ম কিন্তু ক্ষমা করবে না। মমতা বলেন–তিনি বঙ্গবাসীর পাহারাদার। তা মুখের কথাই থেকে যাবে। ফের ঘটে যাবে আরও এক নিঃশব্দ বিপ্লব।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here