শুধু তৃতীয় বিশ্বের দেশ নয়, নারী নির্যাতনের ব্যাধিতে আক্রান্ত প্রায় গোটা বিশ্বই। শুধু তার চেহারাটাই যা আলাদা। লিখছেন সফিউন্নিসা
শিক্ষায় গোটা দেশের মধ্যে সেরার শিরোপা। বামশাসিত কেরল গত নির্বাচনেও ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে শুভবুদ্ধির পরিচয় দিয়ে মানুষের অধিকারের ওপর তাদের বিশ্বাসে সিলমোহর দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে মানুষের নিজস্বতা, তাদের বেঁচে থাকার অধিকার, আত্মমর্যাদাই শেষ কথা। অথচ সেই কেরালাতেই বেড়ে চলেছে নারীনিগ্রহের ঘটনা। পরিসংখ্যান বলছে, গত দশ বছরে কেরালায় মহিলাদের বিরুদ্ধে ১ লক্ষ ৩২ হাজার ৩৬৫টি মামলা হয়েছে। তার মধ্যে ১১ হাজার ৩২৫টি ধর্ষণের মামলা রয়েছে। আর চলতি বছরে ১১ হাজার ১টি নারী নির্যাতন সংক্রান্ত মামলা হয়েছে। তার মধ্যে ৩ হাজার ৪০৭টি শ্লীলতাহানির ঘটনা রয়েছে। আর খোদ রাজধানী তিরুবনন্তপুরমে ১৫৭ জন মহিলা ধর্ষিতা হয়েছেন।
নারী লাঞ্ছনার বেড়ে চলা এই রেখাচিত্র বদলে দিতে কেরালা সরকারের মুখ্যমন্ত্রী পিনারয়ী বিজয়ন পুলিশ-প্রশাসন ব্যবস্থা নিচ্ছে বলে যে সাফাই-ই দিক না কেন, এ কথা বলা যেতেই পারে যে, বাম আদর্শ কেরালার মানুষকে আজও তাহলে নারীপুরুষের সমানাধিকারে দীক্ষিত করতে পারেনি! যার জন্য পথে নামতে হচ্ছে বামপন্থীদের! নারীর অধিকার শব্দটি আজও অন্যান্য রাজ্যের মতো সোনার পাথরবাটি হয়েই রয়ে গিয়েছে এই রাজ্যেও! সংসারে নারীর অবস্থান সম্পর্কে বলতে গিয়ে লেনিন বলেছিলেন, ‘‘একটি কমিউনিস্টের গায়ে নখের আঁচড় দিয়ে দেখ, তার সংকীর্ণমনা চেহারা বেরিয়ে পড়বে।…অবশ্য নরম জায়গায় আঁচড়ে দেখতে হবে – নারীদের বিষয়ে তাদের মনোভাব কী। কেমন করে নারীরা ক্ষুদ্র একঘেয়ে ঘরকন্নার কাজে জরাজীর্ণ হয়ে যায়, তাদের শক্তি ও সময় বিক্ষিপ্ত ও বিনষ্ট হয়, তাদের মন সংকীর্ণ ও বিস্বাদ হয়ে পড়ে, তাদের নিঃশ্বাস মন্থর হয়ে আসে, ইচ্ছাশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে তা দেখেও পুরুষরা নারীদের নীরব আত্মদান ভোগ করে আসছে। এর চেয়ে সংকীর্ণ মনের বড় প্রমাণ আর কি হতে পারে?’’
‘‘যতক্ষণ না নারীরা পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করছে, ততক্ষণ সর্বহারা তার তার পূর্ণ অধিকার পেতে পারে না।’’
১৯১৮ সালে প্রথম সারা রাশিয়া নারীশ্রমিক সম্মেলনে লেনিন তাঁর বক্তৃতায় বলেছিলেন,‘‘সমস্ত সভ্য দেশে, এমনকী সবচেয়ে উন্নত দেশেও নারীরা আজ এমন অবস্থায় আছে যে, তাদের পারিবারিক দাসীই বলা চলে। একটিও ধনতান্ত্রিক দেশে, এমনকী সবচেয়ে স্বাধীন রিপাবলিকেও নারীরা সম্পূর্ণ সমান অধিকার পায় না।’’ আবার নারীদের বিষয়ে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো এক জায়গায় বলেছে, ‘‘বুর্জোয়ারা তাদের স্ত্রীদের শুধুমাত্র সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসাবেই দেখে। তাই তারা যখন শোনে যে উৎপাদনের যন্ত্রগুলি সব সামাজিক সম্পদে পরিণত হবে, তখন তারা এ ছাড়া কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারে না যে, নারীরাও সর্বসাধারণের ভোগ্য হিসাবে ব্যবহৃত হবে।…তারা ভাবতেই পারে না যে, আমাদের প্রকৃত লক্ষ্য নারীদের শুধু সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসাবে থাকার সামাজিক হীন অবস্থার অবসান করা।……নারীদের সাধারণের ভোগ্য সম্পত্তিতে পরিণত করার জন্য কমিউনিস্টদের প্রয়োজন নেই–স্মরণাতীত কাল থেকেই সমাজে তা চলে আসছে।’’
১৯২০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এক বক্তৃতায় লেনিন বলেছিলেন,‘‘যতক্ষণ না নারীরা পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করছে, ততক্ষণ সর্বহারা তার তার পূর্ণ অধিকার পেতে পারে না।’’ আজ ২০২১-এ এই কথাগুলি একশো বছর অতিক্রম করে ‘কথা’ হয়েই আছে। গোটা দেশে নারী নির্যাতন ক্রমশ বেড়ে চলেছে। আইনের সুরক্ষা তাদের কাছে অধরা। আইনরক্ষক থেকে শুরু করে প্রশাসনের সর্বস্তরেই নারীনিগ্রহের বিষয়টিকে আমল দেওয়ার অভ্যাস আজও তৈরি হয়নি। সমাজের প্রায় সর্বত্র নারীর ওপর ঘটে চলেছে নিত্য পৈশাচিক অত্যাচার। ১ বছরের শিশু থেকে ৮০ বছরের বৃদ্ধাও আর নিরাপদে নেই। দলিত কিংবা দুর্বল শ্রেণির নারীদের অবস্থা শোচনীয়। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার পথ তাদের জানা নেই। কেননা সেটাই স্বাভাবিক বলে দেখতে অভ্যস্ত সমাজ। এ কারণেই শুধু তৃতীয় বিশ্বের দেশ নয়, নারী নির্যাতনের ব্যাধিতে আক্রান্ত প্রায় গোটা বিশ্বই। শুধু তার চেহারাটাই যা আলাদা। চিন-জাপান তো আছেই, ইউরোপের বিভিন্ন উন্নত দেশের পুরুষদের অনেকেই নিত্য বউ পিটিয়ে পরমানন্দ লাভ করে। এ সব মনগড়া কথা নয়। এক এক সময়ে প্রকাশিত সরকারি পরিসংখ্যানে দেওয়া তথ্য।
‘‘নারীদের মুক্তি দেওয়ার জন্য সব রকমের আইন পাশ হওয়া সত্ত্বেও তারা পারিবারিক দাসীই থেকে যায়…’’