মেয়েরা নিজেদের শরীরের মালিক নন, বলছে সমীক্ষা। এ নিয়ে লিখছেন সফিউন্নিসা
রাষ্ট্রপুঞ্জ ৫৭টি দেশে সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছে কোথাও নারীর নিজের শরীরের উপর নিজের অধিকার নেই। এই প্রথম ইউনাইটেড নেশনস পপুলেশন ফান্ড ‘মাই বডি ইজ মাই ওন’ নামে সমীক্ষায় ধর্ষণ, বলপূর্বক গর্ভধারণ, কুমারীত্বের পরীক্ষা, যৌনাঙ্গছেদন-সহ বিভিন্ন নিগ্রহজনিত কর্মকাণ্ডে নারীদের মতামতকে কোথাও মান্যতা দেওয়া হয় না বলে জানিয়েছে। সংস্থার প্রধান নাতালিয়া কানেম বলেছেন, ‘‘যৌন সম্পর্কে যাবেন কিনা, গর্ভনিরোধক ব্যবহার করবেন কিনা, স্বাস্থ্যপরিষেবার সুযোগ নেবেন কিনা– এ সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা পৃথিবীর অর্ধেক নারীর নেই। কারণ, মেয়েরা নিজেদের শরীরের মালিক নন।’’ সমীক্ষা আরও জানিয়েছে, ৩০টি দেশে এখনও মেয়েদের চলাফেরার পূর্ণ স্বাধীনতা নেই। ৪৩টি দেশে বৈবাহিক ধর্ষণের বিরুদ্ধে আইন নেই। আর ২০টি দেশে ধর্ষিতাকে বিয়ে করে ধর্ষকের অপরাধমুক্ত হওয়ার সুযোগ রয়েছে।
নামজাদা ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাকৃত সমীক্ষা বলে এটি হয়তো মানুষের জানা বিষয় হলেও তারা জানল নতুন করে। কিন্তু সংবাদটি ঠাঁই পেল নামী বাংলা সংবাদপত্রের আটের পাতার এককোণে ছোট্ট ডিসি নিউজ হিসাবে। বোঝাই যায় মেয়েদের অধিকারের বিষয় নিয়ে অধিক মাথা ঘামাতে রাজি নয় সুসভ্য শ্রেণির মানুষও। কেননা এটাই দস্তুর। উন্নত, উন্নয়নশীল, অনুন্নত সব দেশেই চিরকালই মেয়েরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসাবে গণ্য হয়ে আসছে। আসলে পৃথিবীর কোনও শাস্ত্রে কোথাও কি নারীকে সম্মান দিতে দেখা গিয়েছে?
পরিবার কন্যাসন্তানদের পরগাছা হিসাবে বড় করে তোলে। শৈশব থেকে বুঝিয়ে দেয় এটি তার নিজস্ব ঘর নয়। আর স্বামীর বাড়িকে তো পরের বাড়ি হিসাবেই অহরহ শুনিয়ে বোঝানো হয়–সেখানেই তার স্বর্গ, তাই যেভাবেই হোক সেই স্বর্গে টিকে থাকতেই হবে তাকে। আর কোথাও ঠাঁই নেই তার।
অতি আধুনিক মানুষও নারীকে তার প্রাপ্য অধিকার দেওয়ার কথা ভাবে না। শুধুমাত্র নারীকে পদানত রাখার জন্য কত মিথ, কত গল্পকাহিনী রচিত হয়েছে। নারীকে নিয়ে অসংখ্য প্রবাদবাক্য তৈরি হয়েছে। নারী যে পুরুষের জন্য বলিপ্রদত্ত, শুধু এই অমানবিক তত্ত্বটিকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য যুগ যুগ ধরে অসংখ্য বাণী প্রচার হয়েছে। পুরুষের তৃপ্তি, তুষ্টিতে যে তার জীবনের চরিতার্থতা, পুরুষের পায়ের তলায় তাদের স্বর্গ, আরও কত আপ্তবাক্য ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সুনিপুণভাবে তার ইয়ত্তা নেই। এতেও নিশ্চিন্ত হতে পারেনি পুরুষ। এইসব পবিত্র বাণী, বিধি নিষেধ উপেক্ষা করলে তার পরিণতি যে কী ভয়াবহ, তা-ও তারা মেয়েদের মস্তিষ্কে আশৈশব গেঁথে দেয়। তারজন্যও রচিত হয়েছে অসংখ্য গল্প।
মেয়েদের রক্ষা করার দায় ঠেলে দেওয়া হয়েছে তাদেরই উপর। কেন তারা উত্তেজক পোশাক পরবে, এই প্রশ্ন তোলা হয় ধর্ষণের ক্ষেত্রে। যেন পুরুষ অসহায়। ধর্ষণ করা ছাড়া তার উপায় ছিল না। শাস্তিই বা পায় ক’জন? সামাজিক পরিস্থিতি এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে এই জঘন্য অপরাধের বিচার চাইতে গেলে মেয়েটির সম্মান, সম্ভ্রম সব নষ্ট হবে, এই আশঙ্কায় সিঁটিয়ে থাকেন তার অভিভাবকরা। আইনের দ্বারস্থ হতে ভয় পান অত্যাচারিতরাই। প্রশাসন, এমনকী আত্মীয়-স্বজনরাও অনেক সময় ধর্ষককে বাঁচাতে আর মেয়েটির সম্মান(!) রক্ষা করতে দু’জনের বিয়ে দেওয়ার মতো জঘন্য কাজও করেন অবলীলায়।
পুরুষরা অনেকেই বলেছিলেন, স্ত্রীর সঙ্গে রাত্রিবাসের আগে তাঁকে দিয়ে মুচলেকায় সই করিয়ে নিতে হবে। ব্যাপারটা পুরুষের কাছে এতটাই গুরুত্বহীন যে, তা নিয়ে কেউ বিন্দুমাত্র মাথা ঘামাতে রাজি ছিলেন না।