মা ভৈ! বিকৃত রুচির পুরুষ

প্রতীকী। ছবি–সংগৃহীত

শরীরের সঙ্গে শরীর, বিচারপতির ভাষায় ‘স্কিন টু স্কিন কনট্যাক্ট’ না হলে তো তাকে ধর্ষণ দূরের কথা, যৌন নির্যাতনও বলা যাবে না। এ নিয়ে লিখছেন সফিউন্নিসা

সামনে সেই দিন আসছে, যে দিন ধর্ষণের নায়করা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াবে আর ছিন্নভিন্ন তাদের শিকাররা থানা থেকে হাসপাতাল ঘুরে এসে মেয়ে হয়ে জন্মানোর জন্য নিজেদের ভাগ্যকে অভিসম্পাত দেবে। কেননা ডাক্তারি পরীক্ষায় আঘাত, রক্তপাতের প্রমাণ  থাকলেও পুরুষ-শরীরের কোনও চিহ্ন পাওয়া যাবে না। ধর্ষকদের পক্ষে দাঁড়ানো উকিলদের পরিশ্রমও কমবে। কেননা তাঁদের চালাক মক্কেলরা আটঘাট বেঁধে কাজে নেমেছিল। শরীরের সঙ্গে শরীর, বিচারপতির ভাষায় ‘স্কিন টু স্কিন কনট্যাক্ট’ না হলে তো তাকে ধর্ষণ দূরের কথা, যৌন নির্যাতনও বলা যাবে না। সম্প্রতি বোম্বে হাইকোর্টের মহিলা বিচারপতির দেওয়া রায় ধর্ষকদের আরও চালাকির সুযোগ করে দিল। তারা এখন থেকে কন্ডোম পরেই কাজে নামবে।

    নারী নির্যাতনের পরিসংখ্যানে যেখানে সারাদেশে প্রতিদিন কয়েক হাজার নারীর ধর্ষণ, অত্যাচার, পণজনিত খুন আর আত্মহত্যার ভয়াবহ ছবি উঠে আসে, সেখানে এই ধরনের রায় যে নারীকে আরও অসহায়, আরও অত্যাচারের মুখে ফেলে দেবে– একথা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে। আর এই রায় যে একজন নারীর কাছে কতটা অপমানজনক, তার চুলচেরা বিচার করবে দেশের শীর্ষ আদালত।  গত ১৯ জানুয়ারি বোম্বে হাইকোর্টের নাগপুর বেঞ্চের বিচারপতি পুষ্পা গনেড়িওয়ালা এক মামলার রায়ে বলেছেন–পোশাকের ওপর দিয়ে নাবালিকার স্তনে হাত দিলে পকসো আইনে তাকে যৌন নিগ্রহ বলা যাবে না। অভিযুক্ত যদি তার পোশাক অনাবৃত না করে তবে তাকে দোষী বলা যায় না। ‘চমৎকার’ এই রায়ের বিরুদ্ধে জাতীয় মহিলা কমিশন সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হলে ২৭ জানুয়ারি সেই রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ দিয়েছে শীর্ষ আদালত।

    আত্মীয়-অনাত্মীয়, পথ চলতি লোক আর ভিড়ের সুযোগে বেপরোয়া হাত নানাভাবে পেষণ করে আসছে বোধ জন্মানোর আগেই শিশুকন্যাদের। যুগ যুগ ধরে। আইনের পথে যেতে পারে ক’জন? বিশেষ করে অপরাধীকে যদি চিহ্নিত না করা যায়! শিশুশ্রেণিতে পড়া কচি বাচ্চাকেও গাড়ির অনেক ‘হেল্পার কাকু’ নামিয়ে দেওয়ার ছলে যা করার করে নেয়। পকসো আইনে এতদিন এটা অপরাধ জেনেও এ সব ঘটে চলছিল। এখন তো এইসব বিকৃতকামীরা নিরপরাধী গণ্য হওয়ার আনন্দে ব্যাপারটা খুল্লামখুল্লা ঘটিয়ে স্রেফ অস্বীকার করে পার পেয়ে যাওয়াই শুধু নয়, উলটে অভিযোগকারীকে ‘উপযুক্ত শিক্ষা’ দিয়ে ছেড়ে দেবে।

অভিযুক্ত যদি তার পোশাক অনাবৃত না করে তবে তাকে দোষী বলা যায় না। ‘চমৎকার’ এই রায়ের বিরুদ্ধে জাতীয় মহিলা কমিশন সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হলে ২৭ জানুয়ারি সেই রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ দিয়েছে শীর্ষ আদালত।

    কন্যাসন্তানকে নিয়ে বাবা-মা এমনিতেই বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শঙ্কিত ও সতর্ক থাকেন। এই ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন (ক্ষমা করবেন) রায় তাঁদের দিশাহারা করে তুলবে। আরও দুর্ভাগ্য এটা যে, আমাদের দেশে কন্যাসন্তান আদৃত নয় অধিকাংশ পরিবারে। কন্যাভ্রূণহত্যা চলছে আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, গোপনে টাকার বিনিময়ে। দীর্ঘকাল ধরে এই অনভিপ্রেত মানসিকতার কারণে কন্যাসন্তানের সংখ্যা পুরুষের অনুপাতে উদ্বেগজনকভাবে কমে গিয়েছে। অশিক্ষিত মানসিকতার অধিকাংশ পরিবার এখনও বাড়ির বধূর কন্যাসন্তান জন্মালে তার জন্য মাকেই দোষারোপ করে, তাঁর ওপর চরম নির্যাতন চালায়। এমনকী সেই ‘অপরাধে’ মাকে হত্যাও করা হয়েছে, এমন ঘটনা বিরল নয়। আসলে সেই পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা—তে পড়ে রয়েছে অধিকাংশ পরিবারের মানসিকতা। কন্যাসন্তানের জন্য কী সুন্দর পৃথিবীই না রচিত হচ্ছে দিনে দিনে!

    বাসে, ট্রেনে নানারকম চোরাগোপ্তা হাতের কারসাজি নিত্য মেয়েদের সহ্য করতে হয়। কর্মস্থলে যৌন হেনস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে, তা রোধ করার জন্য এ বিষয়ে আইন পাশ হয়। মেয়েদের সম্ভ্রম নিয়ে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা, কাজ করা কেন নির্বিঘ্ন হবেনা? নির্ভয়ার অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ব্যাপারটিকে দোষের বলে মানতে পারেনি শেষ পর্যন্ত। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তারা বিশ্বাস করত যে, রাতে ভালো মেয়েরা রাস্তায় ঘোরে না। তাদের সঙ্গে এইরকম ঘটনা দোষের কিছু নয়। এই মানসিকতা তারা পেয়েছে উত্তরাধিকার সূত্রে, পারিবারিক আবহে। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা শুধু পুরুষরাই বহন করে না, তাদের চেয়েও কোথাও কোথাও বেশিমাত্রায় বহন করে এই বোধে মগজধোলাই হয়ে যাওয়া মেয়েরাও। এরাই মেয়েদের জন্য অনেক বেশি ক্ষতিকর ভূমিকা পালন করে। মেয়েদের আরও অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার প্রক্রিয়াটাকে খুব সক্রিয়তার সঙ্গে পালন করে তারা বাহবা কুড়ায় হয়ত বা জনপ্রিয়তাও অর্জন করে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here