শীতের মরসুমে নলেন গুড়ের নাম শুনলেই জিবে জল আসে। অনলাইনে অর্ডার দিলেই দোরগোড়ায় পৌঁছে যাচ্ছে টিউবে ভরা এই গুড়। লিখছেন অনিমেষ বসু সরকার এবং শ্যামলী বন্দ্যোপাধ্যায়
খেজুর গাছের জিরানকাটের রস থেকে তৈরি গুড়ের স্বাদই আলাদা। এর যেমন স্বাদ তেমনি মিষ্টি গন্ধ। তবে স্বাদ-গন্ধ ছাড়াও এর উপকারিতা কম নয়। শীতের মরসুমে এই রস থেকে তৈরি গুড় নাগরিতে ভরে গ্রাম থেকে শহরে আসে। সেই গুড় কেনার অপেক্ষায় থাকেন ভোজনরসিকরা। তাই কবিগুরুর কথায় বলা যেতেই পারে–
রসগোল্লার লোভে
পাঁচকড়ি মিত্তির
দিল ঠোঙা শেষ করে
বড় ভাই পৃথ্বীর।
দিন বদলের সঙ্গে নলেন গুড়ের বাণিজ্যিকীকরণেও এসেছে বদল। তাই এই গুড় এখন টিউবে ভরে বিকাচ্ছে। রাজ্যের মধ্যে একমাত্র নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জ থানার ভাজনঘাটের একটি কারখানাতে নলেন গুড় তৈরি করে টিউবে ভরা হচ্ছে। বিপণনের দায়িত্বে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ খাদি ও গ্রামীণ শিল্প পর্ষদ। তাদেরই অর্থানুকূল্যে কারখানাটি চালাচ্ছে ‘শ্রীকৃষ্ণ নলেন গুড় টিউব উৎপাদন সমিতি’।
গান্ধীজি বিশ্বাস করতেন যে, খাদি কেবল স্বাবলম্বনের হাতিয়ার বা জাতীয়তাবাদের প্রতীকই নয়, এটি জাতির অর্থনৈতিক বিকাশেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। সেইমতো গান্ধীজি ১৯৩৩ সালের ডিসেম্বরে অল ইন্ডিয়া খাদি বোর্ড গঠন করেছিলেন। ১৯৫৩ সালের জানুয়ারিতে ভারত সরকার সর্বভারতীয় খাদি এবং গ্রামীণ শিল্প বোর্ড গঠন করে। এরপর ১৯৬০ সালের ১ এপ্রিল তৈরি হয় পশ্চিমবঙ্গ খাদি ও গ্রামীণ শিল্প পর্ষদ। সংস্থাটির মূল ভূমিকা হ’ল উদ্যোক্তা, কর্মসংস্থান এবং জীবিকার সুযোগ তৈরি এবং প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি করা। তারই একটি অঙ্গ নলেন গুড়ের উৎপাদন এবং টিউবে ভরে বিপণন।
নলেন গুড়ে আছে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট, জিংক, সেলেনিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, পটাশিয়াম, আয়রন, ক্যালসিয়ামের মতো নানা উপাদান। আর সুস্থ থাকতে এই সব উপাদান খুব দরকার। আর চিনির তুলনায় গুড় অনেক বেশি উপকারী। কারণ, চিনিতে এম্পটি ক্যালোরি থাকে বলে তা শরীরের তেমন কোনও উপকারে আসে না। কিন্তু গুড় তুলনায় অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর।
নলেন গুড়ের মধ্যে ভালো পরিমাণে আয়রন থাকে। আমাদের সারাদিনে যে পরিমাণ আয়রন দরকার, মাত্র দশ গ্রাম গুড় খেলে তার দু’-থেকে তিন শতাংশ এর চাহিদা মিটে যায়। এ কারণে আমাদের মতো গরিব দেশে সরকারি তরফে সন্তানসম্ভবা বা বাচ্চাদের জন্য যে খাবার তৈরি করা হয়, সবেতেই গুড় ব্যবহার করা হয়, যাতে তাদের শরীরে আয়রনের পরিমাণ বাড়ে। কাজেই যাঁরা রক্তাল্পতায় ভুগছেন বা যাঁরা আয়রনের অভাবজনিত সমস্যায় ভুগছেন, তাঁরা শীতকাল ছাড়াও অন্য সময়ে রোজ গুড় খেলে উপকার পাবেন বলে চিকিৎসকদের মত। তাঁরা বলছেন–
গুড়ের মধ্যে থাকে জিঙ্ক ও সেলেনিয়াম। এই দুই উপাদান অ্যান্টি অক্সিডেন্টের কাজ করে। ফলে, বয়সের ছাপ পড়া আটকাতে পারে। এ ছাড়াও ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে ও হাইপারটেনশন কমাতেও গুড় সাহায্য করে।
শীতের সময় হাইপারটেনশনের রোগীদের অনেকেরই রক্তচাপ একটু বেড়ে যাওয়ার সমস্যা হয়। এ ক্ষেত্রে নলেন গুড় খেলে উপকার মেলে। এতে সেলেনিয়াম ও ক্রোমিয়াম থাকার জন্য ডায়াবেটিস রোগী যদি মিষ্টি কিছু খেতেই চায়, তা হলে গুড় খেতে পারে। চিনি খেলে এ ধরনের রোগীদের ক্ষতি হবে। কিন্তু সামান্য গুড় খেলে কোনো ক্ষতি হবে না। এ ছাড়া এতে ম্যাগনেসিয়াম থাকার জন্য স্নায়ুর ক্রিয়া ভালোভাবে কাজ করতে পারে।
গুড়ে অনেকরকম ফাইটোকেমিক্যাল থাকে। ফলে লিভার থেকে ক্ষতিকর পদার্থ বের করতে সাহায্য করে। এ ছাড়াও গুড় খাওয়ার পরে হজমের জন্য দরকারি এনজাইমের পরিমাণ বেড়ে যায়। কাজেই খাবার পর প্রতিদিন যদি একটু করে গুড় খাওয়া যায়, তা হলে হজমের সমস্যা থেকে দূরে থাকা যায়। এমনকী গলব্লাডারের কাজও ঠিকমতো করতেও সাহায্য করে। সর্দি-কাশিতেও কাজ দেয়। তাই শীতের সময় সর্দি-কাশির সমস্যা থেকে দূরে থাকতে হলে গুড় খাওয়া যেতেই পারে।
গুড় হল স্টোর হাউস অফ ভিটামিন ও মিনারেলস। গুড়ে ভালো মাত্রায় সোডিয়াম ও পটাশিয়াম থাকে। অনেক সময়ে আমাদের পায়ের কাফ মাসলে ব্যথা হয়। তার কারণ সোডিয়াম ও পটাশিয়ামের ভারসাম্যের অভাব। গুড় খেলে এই সমস্যা থেকে দূরে থাকা যায়।