নারীর সম্মান বাড়িয়ে চলেছেন আধুনিক মহাপুরুষেরা

প্রতীকী। ছবি–সংগৃহীত

মেয়েদের প্রগতির দৃশ্যপটের বিপরীতে সীমাহীন অন্ধকার। লিখছেন রত্না চৌধুরি

প্রায় প্রতিদিন রাজনীতির মহাজনেরা নারীদের বিষয়ে এক একটি বাণী বিতরণ করছেন। সংবাদপত্রের দৌলতে তা নিয়ে নানারকম সমালোচনা, ক্ষোভ প্রকাশ করছেন ভদ্রজনেরা। তারপর খুব দ্রুত তা থিতিয়ে পড়তে না পড়তেই নতুনতর বাণী নিয়ে অবতীর্ণ হচ্ছেন আরও এক মহাজন। সম্প্রতি এমনই এক নারীদরদি জনপ্রতিনিধি ধর্ষিতা মেয়েদের অপমান আর লজ্জা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার একটি মোক্ষম উপায় বাতলেছেন। তিনি এই দুর্ভাগ্যের শিকার হওয়া মেয়েদের আত্মহত্যা করে বাঁচার পথ দেখিয়েছেন।

    নিশ্চয়ই মেয়েরা ভুলে যাননি কিছুদিন আগে দক্ষিণ ভারতের এক আবাসিক হস্টেলে পড়ুয়া মেয়েদের প্রতি ফতোয়া জারি করা হয়েছিল যে, রজঃস্বলা অবস্থায় তারা ডাইনিং রুমে প্রবেশ করতে পারবে না। তাতে নাকি সব খাবার অপবিত্র হয়ে যাবে। মেয়েরা অবশ্য তার কোনও প্রতিবাদ  করেনি। হস্টেলের সুপার কিন্তু প্রচণ্ড কর্তব্যনিষ্ঠ। তিনি এ ব্যাপারে কোনওরকম সন্দেহের অবকাশ রাখতে চাননি। শৌচাগারে ঢুকিয়ে মেয়েদের বিবস্ত্র করে পরীক্ষা করে তবে তিনি নিরস্ত ও নিশ্চিন্ত হয়েছেন। এই ঘটনা মেনে নিতে পারেনি কয়েকজন ছাত্রী। তারা প্রতিবাদে সরব হয়ে ওঠে। ঘটনা গড়ায় মিডিয়া পর্যন্ত। ফলে এ খবর পৌঁছে যায় অনেক দূর। প্রশাসন তদন্তের নির্দেশ দিয়ে কর্তব্য শেষ করে।

 অবাধে আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে কন্যাভ্রূণ হত্যা চলছে। এরই মধ্যে এক গুরু বয়ান দিয়েছেন, মেয়েদের জন্মই নাকি হয় পুরুষের সেবাদাসী হওয়ার জন্য।

    এই ঘটনার অব্যবহিত পরেই ঘটে যায় আরও এক ‘যুগান্তকারী’ ঘটনা। কোনও এক গুরুদেব ঘোষণা করে বসলেন রজঃস্বলা অবস্থায় কোনও নারী যদি রান্নাবান্না করে স্বামীকে খাওয়ায়, তবে সেই ভদ্রলোক পরজন্মে কুকুর হয়ে জন্মগ্রহণ করবেন। ভদ্রমহিলাও মনুষ্যেতর যোনিপ্রাপ্ত হবেন। অথচ, আমরা নাকি রকেটের গতিতে প্রগতির দিকে এগিয়ে চলেছি? বায়ুসেনা বাহিনীতে মেয়েরা জায়গা করে নিচ্ছে, মহাকাশযানে সওয়ার হচ্ছে, বিজ্ঞান গবেষণায় নোবেল পাচ্ছে—সবই সত্যি। আবার এইসব দৃশ্যপটের বিপরীতে সীমাহীন অন্ধকার। সেই জগতে আজও ডাইনি হত্যা হয়ে চলেছে অবলীলায়। সেক্সট্রেড এখন সবচেয়ে লাভজনক হয়ে উঠেছে। নারীপাচারের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অনেক রাঘর-বোয়ালের নাম। অবাধে আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে কন্যাভ্রূণ হত্যা চলছে। এরই মধ্যে এক গুরু বয়ান দিয়েছেন, মেয়েদের জন্মই নাকি হয় পুরুষের সেবাদাসী হওয়ার জন্য। বিনিময়ে তারা খেয়েপরে জীবনধারণ করার দুর্লভ সুযোগ পায়।

    একবিংশ শতকের অধিকাংশ নারীর এ সব নিয়ে অপমানিত হওয়ার মতো চেতনা তৈরি হয়নি। তারা অনেকেই এতেই গৌরবান্বিত বোধ করে। রূপ কানোয়ারের কথা মনে আছে? আঠারো বছরের মেয়েটিকে ‘সতী’ বানানোর জন্য সমবেতভাবে প্রকাশ্যে যেভাবে খুন করা হয়েছিল, সেই সতীপিঠে মেয়েরা প্রণাম করতে কী করে যায়? কিছুদিন আগে যে দুষ্কৃতীরা বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙেছিল, তাদের সমর্থন করে সমাজমাধ্যমে পোস্ট করেছিল আরও কিছু অমানুষ। তাদের কারও কারও বক্তব্য ছিল, বিদ্যাসাগর নাকি সনাতন সমাজের ঐতিহ্য ও সংস্কারে আঘাত করে সমাজের ক্ষতি করেছেন। অর্থাৎ বাল্যবিবাহ সঠিক ছিল, বহুবিবাহ যথাযথ নিয়ম ছিল, বিধবাবিবাহ ভুল ছিল। এই প্রথাগুলির প্রতি দুষ্কৃতীরা যে সম্মান  ব্যক্ত করেছিল, তাতে সহজেই অনুমান করা যায়, সমাজসংস্কারক হিসেবে তারা যদি কোনওদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে, তবে মেয়েরা দুশো বছর আগের সুবর্ণমণ্ডিত সমাজে আবার ফিরে যাবে। সেখানে সতীদাহ চলবে, কুলীনরা আবার খেরোর খাতা নিয়ে কুলীনদের মান রক্ষা করতে পথে বেরিয়ে পড়বেন। শতাধিক বিয়ের মাধ্যমে সমাজের অশেষ উপকার সাধন করবেন। কাজেই বাহিনীর মেয়েরা পারবেন তো সেদিন আপনাদের সযত্ন লালিত পুত্রদের নিবৃত্ত করতে? নাকি এটাকেও  ঐতিহ্য হিসেবে সম্মানের সঙ্গে মেনে নেবেন? উত্তর ভবিষ্যৎ দেবে।

    নারীর মূল্য যেভাবে প্রায় প্রতি রাজ্যে বেড়ে চলেছে, ধর্ষণের ঘটনা  যেভাবে প্রতিক্রিয়াহীন ও স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে উঠছে, ধর্ষকদের যেভাবে শিশু হিসেবে গণ্য করে তাদের রক্ষা করার জন্য মহাজনেরা অতি তৎপর হয়ে উঠছে, তাতে সন্দেহ হয় একে জঙ্গলের রাজত্ব বলে উপমা টানলে পশুরা তার প্রতিবাদে মিছিলে সামিল হবে। নারীদের সামনে আপাতত নারীশূন্য পৃথিবীর জন্য প্রার্থনা ছাড়া সম্ভবত দ্বিতীয় কোনও পথ খোলা নেই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here