পরের বছর এপ্রিল–মে মাস নাগাদ পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন। ইতিমধ্যে সংগঠন গুছিয়ে নিতে শুরু করেছে রাজ্যের প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল। ৭ ডিসেম্বর থেকে জেলায় জেলায় প্রচার শুরু করছেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর তার মধ্যেই সংখ্যালঘু ভোটব্যাংক কোন শিবিরে যাবে, তা নিয়ে শুরু হয়েছে টানাপোড়েন। আসলে সংখ্যালঘু ভোট প্রার্থীর জয়পরাজয়ে নির্ণয়ক ভূমিকা নেয়। তাই সংখ্যালঘুদের মন জুগিয়ে চলতেই হয় শাসকদলকে। দিনকয়েক আগে পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকির সঙ্গে দেখা করতে ফুরফুরা শরিফে গিয়েছিলেন কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরি ও আবদুল মান্নান। আব্বাস সিদ্দিকি, ইব্রাহিম সিদ্দিকির সঙ্গে তাঁদের বৈঠক হলেও ত্বহা সিদ্দিকির দেখা পাননি অধীররা। ইতিমধ্যে নবান্নে গিয়ে সরাসরি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করেন পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকি। একগুচ্ছ দাবি নিয়ে তিনি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। আসলে দাবি আদায়ের এখনই সুবর্ণ সুযোগ। কারণ, সামনে ভোট।
২১শের রাজ্য বিধানসভার ভোটকে পাখির চোখ করেছে বিজেপি। গেরুয়া শিবিরের কেন্দ্রীয় নেতারা বঙ্গে ঘাঁটি গেড়ে ভোটের রণকৌশল ঠিক করছেন। প্রধানমন্ত্রী থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী–সোনার বাংলা গড়তে চান। বাঙালির আবেগে সুড়সুড়ি দিতে তাঁরা রবিঠাকুরের বাণী আওড়াচ্ছেন। চুপ করে বসে নেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনিও নেতাজির প্রতি ‘বঞ্চনা’ নিয়ে সরব হয়ে বাঙালির আবেগকে উসকে দিতে চেয়েছেন। তাই তিনি নেতাজির জন্মদিনকে জাতীয় ছুটি ঘোষণা করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি দিয়ে দরবার করেছেন। পাশাপাশি আমজনতার সমর্থন পেতে রীতিমতো কল্পতরু হয়েছেন মমতা। তাই তাঁর নবতম সংযোজন ‘দুয়ারে সরকার’। তাতে প্রথম রাউন্ডেই যে সাড়া পড়েছে, তাতে আক্ষরিক অর্থেই চাপের মুখে বিজেপি। তাই পালটা তৎপরতা বিরোধী শিবিরেও। ‘আর নয় অন্যায়’ কর্মসূচির দ্বিতীয় পর্যায় শুরুর কথা ঘোষণা করে রাজ্য বিজেপি’র সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেছেন, প্রচারপত্র হাতে নিয়ে ১ কোটিরও বেশি নাগরিকের দরজায় পৌঁছবেন তাঁরাও। পাশাপাশি বিজেপি’র রাজ্য সভাপতিকে বলতে হচ্ছে, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী দলীয় মঞ্চ থেকে সরকারি প্রকল্প ঘোষণা করছেন। তার পর সরকারি টাকা ব্যবহার করে দলের ছেলেরা দলের পতাকা বাইকে বেঁধে বাড়ি বাড়ি যাচ্ছে। এ ভাবে সরকারি টাকায় দলের প্রচার করা যায় না। এ ব্যাপারে আমরা আদালতের দ্বারস্থ হওয়া যায় কি না তা বিবেচনা করছি। দরকারে নির্বাচন কমিশনের কাছে যাব।’’
গত লোকসভার ভোটের ফল রাজ্য বিজেপিকে অক্সিজেন জোগাচ্ছে। তাই এ বারে বাংলা দখল করতে মরিয়া গেরুয়া শিবির। মমতা তা বুঝেই দলের সংগঠনকে নিচুতলা থেকে ঢেলে সাজিয়েছেন। এমনকী দলে যাঁরা বিতর্কিত, তাঁদেরও দূরে সরিয়ে না রেখে কাছে টেনে নিয়েছেন। তাঁদের ‘মুখ’ জনমানসে বিরূপ প্রভাব ফেলছে কিনা, তা নিয়ে ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোর (পিকে) কতটা ওয়াকিবহাল, তা তিনিই জানেন। তবে বিজেপিকে একইঞ্চি জমি ছাড়তে নারাজ মমতা। তাই মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করে নন্দিগ্রামের বিধায়ক যখন গেরুয়া পতাকাবাহীদের নিয়ে করতাল বাজিয়ে হরিনাম-সংকীর্তন করছেন, তখনও তাঁকে দলে ধরে রাখতে চাইছেন মমতা। যেহেতু, যে কারণে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে শুভেন্দুর দূরত্ব তৈরি হয়েছে, তাকে খাটো করে দেখে ভোটের আগে নিজের পায়ে কুড়ুল মারার ঝুঁকি নেওয়া যে সমীচীন হবে না, তা বুঝেছেন মমতা। তাই তিনি শুভেন্দুর সঙ্গে কথা বলে তাঁর মানভঞ্জনে উদ্যোগী হয়েছেন। তাতে শুভেন্দু-নাটকে যবনিকা পড়বে কিনা, তা নিয়ে ঘোর অনিশ্চয়তা রয়েছে। গেরুয়া শিবির অবশ্য আশাবাদী যে, শুভেন্দু তৃণমূল ছেড়ে গেরুয়া শিবিরেই যোগ দেবেন। এ জন্য দলে তাঁকে যথাযোগ্য সম্মানও দেওয়া হবে। কিন্তু শুভেন্দুর সঙ্গে তৃণমূল নেতৃত্বের যে টানাপোড়েন চলছে, তাতে শেষঅবধি দাঁড়ি পড়লে গেরুয়া শিবিবের হতাশ হয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক। যদিও রাজ্য বিজেপি নেতৃত্বের কথায়, শুভেন্দু যদি তৃণমূলে থেকেও যান, তা হলে ভোটে লড়তে কোনও অসুবিধা হবে না। তাতে ভোটের আগে নারদা-তদন্ত নতুন মোড় নেবে কিনা, তা নিয়েও রয়েছে জল্পনা। এ কারণেই কি মঙ্গলবারের দীর্ঘ কথাবার্তার পর মুখে কুলুপ আঁটেন নারদা-কাঁটায় বিদ্ধ শুভেন্দু? হয় তো না! তবে শুভেন্দু যে দোটানায় রয়েছেন, তা বোঝাই যাচ্ছে। তাই মঙ্গলবার শুভেন্দু–অভিষেক–পিকে’র বৈঠকের পর সৌগত রায় যখন বলেন, সমস্যা মিটে গিয়েছে। বাকিটা ধীরে ধীরে মিটে যাবে। শুভেন্দু তৃণমূলেই থাকবেন। বিধানসভা নির্বাচনে একসঙ্গে লড়বেন, তা শুনেই অসন্তুষ্ট শুভেন্দু। বুধবার তৃণমূলের তরফে তাঁর সঙ্গে আলোচনার দায়িত্বে থাকা সৌগতকে মেসেজ করেছেন তিনি। তাতে শুভেন্দু লিখেছেন, ‘‘আমার বক্তব্যের এখনও সমাধান হয়নি। সমাধান না করেই আমার উপর সব চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ৬ ডিসেম্বর আমার সাংবাদিক বৈঠকে সব বলার কথা ছিল। তার আগেই সংবাদমাধ্যমের কাছে সব বলে দেওয়া হল। আপনাদের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করা মুশকিল। আমাকে মাফ করবেন।’’ এ কথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জানিয়েছেন কি না, তা নিয়ে খোলসা করেননি সৌগত রায়। তবে তিনি বলেন,‘‘উনি (শুভেন্দু) মত বদলে ফেললে আর কথা বলে লাভ কী?’’ তা হলে দৌত্য কি ভেস্তে গেল? ভোটের আগেই রঙ্গমঞ্চে এ আরেক অধ্যায়।