উড়ে আসে না নীলকণ্ঠ পাখি, রাজ-রাজেশ্বরী মনে করায় অতীত

রাজ-রাজেশ্বরী। ছবি– সুখেন চৌধুরী।

করোনা-কাঁটায় বিঁধলেও পুজোর আবহে কৃষ্ণনগরের রাজবাড়ির দেবী মনে করায় পুরানো সেই দিনের কথা। জানাচ্ছেন অনিমেষ বসু সরকার

যুগ বদলেছে বলেই দেবীর পুজোয় এখন আর কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে তোপ দাগানো হয় না। দেওয়া হয় না পশুবলি। শোনাও যায় না নূপুরের আওয়াজ। বিজয়ার পর এখন আর উড়িয়ে দেওয়া হয় না নীলকণ্ঠ পাখি। পর্দানসীন যুগে এই পাখি রাজ-অন্তঃপুরে উড়ে এসে জানিয়ে দিত প্রতিমা নিরঞ্জনের বার্তা।

    কথিত আছে, ১৬৮৩ সালে রুদ্র রায়ই কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে দুর্গোত্সবের প্রচলন করেন। সেই দুর্গোত্সব সর্বজনীন হয়ে ওঠে রুদ্রের প্রপৌত্র মহারাজ উপাধিতে ভূষিত কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের আমলে। ১৭২৮ সালে তিনি নদিয়ার রাজসিংহাসনে বসেন। ইতিহাসের গবেষকদের একাংশের মতে, কৃষ্ণচন্দ্রের যুগেই কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে হিন্দু-মুসলমান স্থাপত্যের সংমিশ্রণে তৈরি হয় এক বিশাল নাটমন্দির। এই  মন্দিরের পঙ্খের কারুকার্য যেটুকু টিকে আছে, তা আজও শিল্পরসিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এখানেই পুজো হচ্ছে দেবীর।

    কৃষ্ণনগরে রাজবাড়ির দেবী দুর্গার লোকায়ত নাম ‘রাজ-রাজেশ্বরী’। যোদ্ধার সাজে সজ্জিতা দেবীর বাহন সিংহ হল ঘোড়ার মতো দেখতে। দেবীর চালচিত্র অর্ধ গোলাকার। বংশানুক্রমে দেবীকে এ ভাবে বানিয়ে আসছিলেন শহরেরই পালপাড়ার মৃৎশিল্পী সাধন পাল। তিনি প্রয়াত হওয়ার পর তাঁর ছেলেদের ওপরই রাজবাড়ি থেকে ঠাকুর বানানোর ভার এসে পড়ে। কিন্তু গত বছর রাজপরিবার থেকে ঠাকুর বানাতে শিল্পী বদল করা হয়। তাতে ধারাবাহিকতার তাল কেটে যায়। তাই এ বার রাজপরিবার থেকে সেই সাধন পালের পরিবারের হাতেই প্রতিমা গড়ার ভার দেওয়া হয়। সেইমতো প্রতিমা গড়েছেন সাধন পালের দুই ছেলে সমীর পাল ও বৈদ্যনাথ পাল। বৈদ্যনাথ পাল জানান, ‘‘বাবা-ই হাতেকলমে রাজবাড়ির ঠাকুর বানানোর কাজ শিখিয়েছেন। বাবা বলতেন– রাজবাড়ির ঠাকুর গড়ার সময় গা ছমছম করে। অনুভূতি হত, কে যেন পিছনে দাঁড়িয়ে আছে।’’ এখনও কী এমন অনুভূতি হয়? উত্তর–‘‘না। আসলে রাজবাড়ির পারিপার্শ্বিক পরিবেশটাই বদলে গিয়েছে। তাই সে রকম কিছু মনে হয় না।’’

 পুজোর শেষে প্রথা মেনে আজও হয় ‘শত্রু বধে’র পালা। পালাটি হল–দেবীকে জলে ভাসিয়ে রাজবংশধর তির-ধনুকের সাহায্যে এক দস্যুকে ধরাশায়ী করে রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করেন। এ ‘দস্যু’ রক্ত মাংসের কেউ নয়।

    তিন দশক আগেও দেবীকে গঙ্গা মাটি দিয়ে গড়ে তোলা হত। এখন জলঙ্গির পাড়ের মাটি তুলে এনে দেবীকে গড়তে হয়। প্রতিমা তৈরির কাজও আজ আর কামান দেগে শুরু হয় না। যষ্ঠীতে আঁকা হয় না দেবীর চোখ। বৈদ্যনাথ জানালেন–মহালয়ার পর সময়মতো একদিন দেবীর চোখ এঁকে দিয়েছি। তিনি মানছেন–একই ভাবে শিল্পীর হাতবদলের ফলে দেবীর সাজের ঘরানাতেও বদল এসেছে।  পাশাপাশি এ বছর দেবীর উচ্চতা দেড়ফুট ছোট করা হয়েছে। কারণ, বাঁশের দোলায় চাপিয়ে বাহকরাই দেবীকে জলে বিসর্জন দেন। রাজাদের আমল থেকে এই প্রথা চলে আসছে। এ বারে করোনার কারণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য প্রতিমা-বাহকের সংখ্যা কমাতেই হবে। তাই ভার কমাতে দেবীর কাঠামোতেও এসেছে বদল। তবে, নদিয়া-রাজদের সময় থেকে উলটোরথের দিন প্রতিমা তৈরির কাজ শুরুর প্রথাটি এখনও চলে আসছে। যথারীতি প্রথা মেনে এখনও ‘বোধ নবমী’তে মঙ্গলঘট স্থাপন করে হোমকুণ্ড জ্বালানো হয়। কুণ্ডটি জলে দশমী পর্যন্ত।

    রাজবংশধর সৌমীশচন্দ্র রায়ের কথায়,‘‘বলদেবের মৃত্যুর সঙ্গে রাজবাড়ির পুজোয় কামান দাগা বন্ধ করে দিতে হয়েছে। আমার ছেলের কান্নায় থামিয়ে দিতে হয়েছে দেবীর পুজোয় পশুবলি।’’ বলদেব ছিলেন রাজবাড়ির রক্ষী। পুরুষানুক্রমে কামান দাগার কৌশলটি তিনিই একমাত্র রপ্ত করেছিলেন। ছেলেবেলায় বলদেবকে  হারিয়েছেন সৌমীশবাবু। তিনি বলেন, ‘‘বলদেবের মৃত্যুর পর রাজবাড়ির পুজোয় আমরা আর কেউ কামান দেগে বিপদের ঝুঁকি নিতে চাই না।’’ তবে, নাটমন্দিরে আজও বসে যাত্রামঙ্গলের আসর। এ আসর কিন্তু কোনও যাত্রাপালা নয়, রাজ-রাজেশ্বরীরর পুজোর উপাচারে একটি ‘মাঙ্গলিক’ পর্ব। তা হল– দেশ ও দশের মঙ্গলের জন্য দশমী পুজোর শেষে যাত্রামঙ্গল পর্বে সবত্সা ধেনু, বৃষ, গজ, অশ্ব, দক্ষিণাবর্ত বহ্নি, দিব্যস্ত্রী, পূর্ণকুম্ভ, ব্রাহ্মণ, নৃপ, গণিকা, পুষ্পমালা, পতাকা, সদ্যমাংস, ঘৃত, দধি, মধু, রজত, কাঞ্চন, ধান্য ও জীবিত মত্স্য দর্শন করে রাজারা একসময়ে রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করেছেন। সূত্র বলছে–এই প্রথাটি আজও রাজবংশধরকে মেনে চলতে হয়। কিন্তু যৌবন, শক্তি, শুদ্ধতা, আন্তরিকতা, ধন-দৌলত আর প্রত্যাশা পূরণের জন্য যাত্রামঙ্গল পর্বের প্রতীকগুলি আজ ‘পুতুল’ হয়ে পুজোর উপাচারে স্থান পেয়েছে। তবে পুজোর শেষে প্রথা মেনে আজও হয় ‘শত্রু বধে’র পালা। পালাটি হল–দেবীকে জলে ভাসিয়ে রাজবংশধর তির-ধনুকের সাহায্যে এক দস্যুকে ধরাশায়ী করে রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করেন। এ ‘দস্যু’ রক্ত মাংসের কেউ নয়। সৌমীশবাবুর সহধর্মিনী অমৃতা রায়ের মতে, ‘‘শত্রুটি হল মাটির তৈরি এক প্রতীকী রূপ। যার অর্থ–দেশ ও দশের মঙ্গল কামনায় শত্রু তাড়ানো।’’

    রাজবাড়ির এই দেবীর বিসর্জন আজ আর জলঙ্গি নদীতে হয় না। দেবীকে বিসর্জন দেওয়া হয় রাজবাড়ির দিঘিতে। কারণ প্রসঙ্গে সৌমীশবাবু জানান, ছয়ের দশকের শেষের দিকে জলঙ্গির দিকে প্রতিমা নিযে শোভযাত্রার সময় দুষ্কৃতীদের হাতে আক্রান্ত হয়েছিলেন তাঁর বাবা সৌরীশচন্দ্র রায়। সেই বিজয়ার সন্ধ্যাতেই তাঁদের পারিবারিক বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, জলঙ্গিতে প্রতিমা নিরঞ্জনের প্রথা পরিবর্তনের সময় হয়েছে। তাই তার পরের বছর থেকেই শুরু হয়েছে রাজবাড়ির দিঘিতে দেবীর নিরঞ্জনের নতুন অধ্যায়। আর এ কারণেই সৌমীশবাবুর কথা মতো, ‘‘আমি আর নীলকণ্ঠ পাখীর যুগ নিয়ে মাথা ঘামাতে চাই না।’’ যদিও শহরের প্রবীণরা পুজোর ঢাকে কাঠি পড়লেই সেই নীলকণ্ঠ পাখির যুগে ফিরে যেতে চান। তাঁরা স্মৃতিকাতর হয়ে ওঠেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here