কুসুমে কুসুমে চরণচিহ্ন, শরৎ এসেছে দ্বারে

ছবি–সংগৃহীত

পুজোর ঢাকে কাঠি পড়তে আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। বাঙালির মন বাঁধন-ছেঁড়া হতে গিয়েও থমকে যাচ্ছে বার বার। লিখছেন সফিউন্নিসা

নানান বিষে জর্জরিত পৃথিবীতে প্রকৃতি চলেছে তার নিজস্ব নিয়মে নিঁখুত সময় মেপে। অতিমারির এই আবহে ঠিক সময়ে বাংলার মাঠ ভরে উঠেছে কাশের সমারোহে, প্রগাঢ় নীল আকাশের বুকে সাদা পেঁজা মেঘের  আনাগোনা। শিউলি যেন এ বার ফুটেছে একটু বেশিই। বাঙালির মন বাঁধন-ছেঁড়া হতে গিয়েও থমকে যাচ্ছে বার বার।

    এ বারের সবকিছুই যে অন্যরকম। পুজো-নির্ঘণ্টও। কারণ, মহালয়ার একমাস পরে পুজো। দেশজোড়া-বিশ্বজোড়া এমন দুর্বিপাকও কেউ দেখেনি আগে। এত মৃত্যু, এত তীব্র ভয়, সেই আবহেও কিছু মানুষের ঘোলাজলে মাছ ধরার সমারোহও দেখা যায়নি আগে। বিশ্বজোড়া মাৎস্যন্যায়ে একমাত্র প্রকৃতিই চলেছে নিয়ম মেনে।

    বাংলায় শারদোৎসব সবার জন্যই নিয়ে আসে ‘নিতুই নব’ হওয়ার মন্ত্র। রঙে-মাধুর্যে-আনন্দে ভরিয়ে তোলে সারা বছরের জমে থাকা ক্লান্ত মানবসত্তাকে। যার রেশ নিয়ে সে চলে আবার এগারোটি মাস। পুজোর মিলনোৎসব তাতে যোগ করে বাড়তি মাত্রা। একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসব হলেও প্রকৃতির সৌন্দর্যের অঢেল দানে মানুষের মন জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে এমনিতেই। শরতের আকাশ-বাতাস আর প্রকৃতি মানব মনে অদ্ভুত এক রসায়ন ঘটিয়ে দেয়।

    এ বছর সেই আনন্দ কতটা মানুষকে জাগিয়ে তুলতে পারবে, তা কেউ জানে না। কোভিড সংক্রমণ বাড়ছে প্রতিদিন। আট মাসেও দেখা মিলল না সংক্রমণ প্রতিরোধী কোনও ওষুধ বা ভ্যাকসিনের। আশাও করা যাচ্ছে না হঠাৎ কোনও ম্যাজিকের মতো ওষুধ এসে হাজির হবে আমাদের সামনে। এখনও পর্যন্ত প্রায় ষাটজন কোভিড-যোদ্ধা চিকিৎসক সংক্রমণে প্রাণ দিয়েছেন। মারা গিয়েছেন বেশ কয়েকজন স্বাস্থ্যকর্মী। কোভিডের কারণে ঘরে ফিরতে চাওয়া অসহায় অসংখ্য শ্রমিকের প্রাণ গিয়েছে পথে। কাজ হারিয়েছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। মাইলের পর মাইল পথ হেঁটে জীবন্মৃত হয়ে যাঁরা ঘরে পৌঁছেছেন, তাঁরা কর্মহীন। অর্ধাহারে অনাহারে ধুঁকছেন। এ বারের শারদোৎসব কী বার্তা বহন করে আনবে তাঁদের জন্য? এরই মধ্যে আশঙ্কার বার্তা শুনিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)–সংক্রমণের আরও একটা বড় ঢেউ আসছে।

আজকের এই অসুস্থ পৃথিবীতে আমরা কেউ কি একা একা ভালো থাকতে পারব? সবাইকে নিয়েই এই সভ্যতা, বেঁচে থাকা, ভালো থাকা–এই পরম সত্যটি যতদিন না আমাদের বোধের গভীরে প্রোথিত হবে, ততদিন বৃথাই আমাদের সভ্যতার অহংকার।

    বেপরোয়া কাউকে কাউকে বলতে শোনা যাচ্ছে, যা হওয়ার হবে। উৎসবে আনন্দ করার জন্য ওসব মাথায় রাখব না। রবিঠাকুর কেন কার উদ্দেশে লিখেছিলেন জানি না–স্মৃতি কাপালিনী পূজারতা, একমনা, / বর্তমানেরে বলি দিয়া করে /  অতীতের অর্চনা।

    এখন হয়তো সচেতন মানুষ তা করবেন না। বিশেষ করে সতর্ক থাকবেন শিশু ও বয়স্কদের কথা ভেবে। আর একটা ভাবনা যদি সবাই একটু ভাবতে পারি! কাজ হারানো, অর্ধাহারে বেঁচে থাকা আমাদের সহনাগরিকদের কথা! কোভিড আবহে মানুষের নৃশংস অনেক রূপ তো দেখা হ’ল। কোভিড-যোদ্ধাদের ভাড়া বাড়ি থেকে উচ্ছেদ, সেবিকাদের পাড়াছাড়া করার অমানবিকতা, আক্রান্ত মানুষকে একঘরে করে দিয়ে তার প্রতি ঘৃণা ছড়ানো, সুস্থ হয়ে ফিরে আসা মানুষকে তার বাড়িতে ঢুকতে বাধা দেওয়া, পাড়ার দোকানদারদের তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিক্রি করতে না দেওয়া, বিশেষ কোনও গোষ্ঠীকে সংক্রমণের জন্য দায়ী করে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ-কটূক্তি করা, তালিকা অনেক বড়। এ সব ট্রাডিশন আমরা অবশ্য বহন করছি যুগ যুগ ধরে। কিছুকাল আগেও কুষ্ঠরোগকে বলা হ’ত ভগবানের অভিশাপ। রোগীদের এতটাই অচ্ছুৎ করে রাখা হ’ত যে, তারা নিজেরাও বিশ্বাস করতো যে, এ তাদের পাপের ফল। সেইসব কুসংস্কার মনের গভীরে আজও সযত্নে পুষে রেখেছি আমরা। তথাকথিত আধুনিক পোশাক আর পুঁথিগত কিছু বিদ্যার অহংকারের আবরণে। উপযুক্ত পরিবেশে তারা ঠিক বেরিয়ে পড়ে নখ-দাঁত বার করে। এ সব থেকে বেরিয়ে একটু কি দাঁড়ানো যায় না অসহায় মানুষের পাশে?

    কারণ, আজকের এই অসুস্থ পৃথিবীতে আমরা কেউ কি একা একা ভালো থাকতে পারব? সবাইকে নিয়েই এই সভ্যতা, বেঁচে থাকা, ভালো থাকা–এই পরম সত্যটি যতদিন না আমাদের বোধের গভীরে প্রোথিত হবে, ততদিন বৃথাই আমাদের সভ্যতার অহংকার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘সমালোচনা’ বইয়ের ‘একটি পুরাতন কথা’ প্রবন্ধে লিখেছেন—‘‘ধর্মের মধ্যে সেই অত্যন্ত বৃহত্ত্ব আছে, যাহাতে সমস্ত জাতি একত্রে বাস করিয়াও তাহার বায়ু দূষিত করিতে পারে না। ধর্ম অনন্ত আকাশের ন্যায়; কোটি কোটি মনুষ্য পশু পক্ষী হইতে কীট পতঙ্গ পর্যন্ত অবিশ্রাম নিঃশ্বাস ফেলিয়া তাহাকে কলুষিত করিতে পারে না। আর যাহাই আশ্রয় কর না কেন, কালক্রমে তাহা দূষিত ও বিষাক্ত হইবেই। কোনোটা বা অল্প দিনে হয়, কোনোটা বা বেশি দিনে হয়।’’

    ‘চারিত্রপূজা’-তে তিনি লিখেছেন–অসতোমা সদগময়, তমসোমা জোতির্গময়, মৃত্যোর্মামৃতংগময়—অসত্য হইতে আমাকে সত্যে লইয়া যাও, অন্ধকার হইতে আমাকে জ্যোতিতে লইয়া যাও, মৃত্যু হইতে আমাকে অমৃতে লইয়া যাও–ইহা আমাদের সকলেরই প্রার্থনা; মানুষের সকল প্রার্থনার মধ্যে এই প্রার্থনা রহিয়াছে।’’ আজ আমাদের সমবেত প্রার্থনা হোক এটিই। আমরা নত হই প্রকৃতির কাছে, নত হই যার যার আরাধ্যের কাছে—প্রার্থনা হোক একটাই, আমাদের সব রকম অন্ধকার থেকে আলোকে উত্তীর্ণ কর।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here