দেরিতে হলেও রবীন্দ্র-চর্চায় কমিউনিস্টদের ভাবনায় বদল এসেছে। ভারত-চিন সম্পর্কের সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে তা নতুন করে বলতেই হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে ভারতের বাজারে চিনের ফলাও ব্যবসা মন্দার মুখে পড়েছে। নিজেদের ভুলের জন্যই তাদের এই অবস্থা, যা চিন এখন ভারতের ঘাড়ে চাপাতে চাইছে। পরে এই চিন-ই হয়তো কোনও এক সময়ে বলে বসতেই পারে যে, ভুলটা তাদের তরফেই হয়েছে। আসলে কমিউনিস্টদের বোধদয় দেরিতেই হয়।
এ কথা বলার প্রাসঙ্গিকতা এখানেই যে, চিন থেকে আসা লগ্নি, পণ্য পরিষেবার উপরে প্রাচীর তোলার ভাবনা শুরু করে দিয়েছে ভারত। ইতিমধ্যে দেশের স্বার্থে ভারতের তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রক পাবজি-সহ ১১৮টি চিনা অ্যাপস্ নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেছে। আর তাতেই চিনের মাথায় হাত পড়েছে। ভারতের বাজারে ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে চিনা সংস্থাগুলি। এই ক্ষতি কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না চিন। তাই চিনের নেতাদের মুখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা শোনা যাচ্ছে। চিনা বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র হুয়া চুনয়িং বলেছেন, ‘‘চিনে তো রবীন্দ্রনাথের কবিতাও বেশ জনপ্রিয়। আমরা কখনও মনে করিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা চিনা সংস্কৃতির উপর আঘাত। তা হলে ভারত কেন পাবজি গেম নিয়ে এত ভয় পাচ্ছে।’’ ইতিহাস কিন্তু অন্য কথা বলছে। ইতিহাস বলছে, ১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন প্রথম চিনের মাটিতে পা রেখেছিলেন, তখন তাঁর চিন সফর খুব একটা সুখকর হয়নি। কারণ সেখানকার তরুণ সমাজের একটা অংশ তাঁকে সাদর আমন্ত্রণ জানায়নি। বামপন্থী চিনা তরুণের দল সেবার বিভিন্ন শহরে রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতার অনুষ্ঠানে বিক্ষোভ দেখায়। আবার ১৯৩০ সালে রাশিয়ার মাটিতে পা রেখে রবীন্দ্রনাথ যে চিঠি লিখেছিলেন, তা নিয়েও তাঁকে বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়। স্ট্যালিন সেখানকার সংবাদপত্রগুলিতে কবির লেখা প্রকাশ বন্ধ করে দেন। ছয়ের দশকে বাংলার কয়েকজন মার্কসবাদী লেখক কবিগুরুর সাহিত্য-দর্শন এবং দক্ষতাকে আক্রমণ করেছিলেন। তাঁকে ‘বুর্জোয়া সাহিত্যিক’ বলে কটাক্ষ করা হয়। সাতের দশকেও নকশাল আমলে কবি অতিবামপন্থীদের দ্বারা সমালোচিত হন। কারণ, তাঁদের মধ্যে একাংশের বদ্ধমূল ধারণা–রবীন্দ্রনাথের কবিতা তরুণ ও যুবসমাজকে মায়ায় আচ্ছন্ন করে দেয়।
এ কারণেই চিনের তরুণ সমাজ সে দিন রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণ করতে পারেনি। পরবর্তীকালে চিনের জনগণ রবীন্দ্রনাথের প্রতি প্রবল শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে। এমনকী চিনের কবিসমাজ রবীন্দ্রনাথের কবিতা নিয়ে উদ্বেল হয়ে উঠেছিল। তাই রবীন্দ্র মূল্যায়নে বামপন্থীদের যে ভুল ছিল, রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তা স্বীকার করেন। প্রমোদ দাশগুপ্ত স্মৃতি বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ টেনে বুদ্ধদেববাবুকে বলতে হয়েছে, কবিকে তাঁরা বুঝতে পারেননি। বুদ্ধদেববাবুর মতে, ‘‘আনন্দ থেকেই কবিতার উদয় হয়। তাই রবীন্দ্রনাথকে আমরা যদি কমিউনিস্টরা ‘আনন্দবাদী কবি’ বলে চিহ্নিত করি, তা হলে ভুল করব। সামাজিক কাঠামো, বিশ্ব, জাতি এবং প্রাচ্য সম্পর্কে তাঁর মতামত এখনও প্রাসঙ্গিক এবং তা অব্যাহত থাকবে।” বলা যেতেই পারে–এই মূল্যায়ন থেকে কবির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করছে চিনা-প্রশাসন। সেইমতো চিনের বাণিজ্য মন্ত্রকের মুখপাত্র গাও ফেং ভারতের পাবজি-সহ ১১৮টি অ্যাপস নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তকে ভুল বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘‘সংস্কৃতির মধ্যে আদানপ্রদান হলে বন্ধুত্ব বাড়বে।’’ তাই তিনি ভারত সরকারকে ‘ভুল’ শুধরে নেওয়ার আবেদন করেছেন। তাতে ভারত সায় দিতে পারছে না। ভারতের অভিযোগ, রবীন্দ্রনাথকে টেনে এনে মুখে সংস্কৃতির কথা আওড়ালেও লাদাখ সীমান্তে সেনা বাড়াচ্ছে চিন। এই প্রেক্ষাপটে লাল ফৌজকে বিশ্বাস করতে পারছে না ভারত। ফলে বেজিংয়ের উপর আস্থা কার্যত তলানিতে ঠেকেছে নয়াদিল্লির। এ নিয়ে দ্বিপাক্ষিক স্তরে আলোচনা চলছে। জল কোন দিকে গড়ায় সেটাই এখন দেখার। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, কমিউনিস্টদের বোধদয় দেরিতেই হয়। হয় বলেই তো রাজ্যপাট চলে যাওয়ার পর বুদ্ধদেববাবুকে বলতে হয়েছে–সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে শিল্পায়নের লক্ষ্যে সরকারের পদক্ষেপ করতে ভুল হয়েছিল।