কবিগুরু লিখেছেন–সার্থক জনম নারী জন্মেছ এই দেশে। কিন্তু সরকারের ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ স্লোগানটিকে ঘিরে একটু খটকা লাগে। তা হলে কি বেটিদের বাঁচতে কোথাও অসুবিধা হচ্ছে? পড়তেও? লিখছেন সফিউন্নিসা
আমজনতার একাংশের জন্য সুখবর। গত ২৪ জুলাই একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত খবরটি হুবহু তুলে ধরা যাক—‘ঢাকঢোল পিটিয়ে চলছে নরেন্দ্র মোদীর ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ কর্মসূচি। তার মধ্যেই বিজেপি শাসিত উত্তরাখণ্ডের উত্তরকাশী জেলা থেকে উঠে এসেছে ভয়াবহ একটি পরিসংখ্যান। এই জেলায় ১৩২টি গ্রামে গত তিন মাসে জন্মানো শিশুদের মধ্যে সবকটিই পুত্রসন্তান। একটিও কন্যাসন্তান নেই তাদের মধ্যে। টনক নড়েছে জেলা-প্রশাসনের। বিধায়ক থেকে আশাকর্মী–সবাইকে নিয়ে বৈঠক হচ্ছে। সমাজকর্মীরা বলছেন, এই পরিসংখ্যানে স্পষ্ট–এইসব এলাকায় ঢালাও কন্যাভ্রূণ হত্যা চলছে । না হলে এটা ঘটা সম্ভব নয়।’ এখন অবশ্য দিন বদলে গিয়েছে, এখন কন্যারা আর সেই জগতে পড়ে নেই, তাদের এখন সর্বত্র সমানাধিকার’ বলে আমরা রীতিমতো গর্ব অনুভব করি। তাই হয় তো কয়েকদিন আগে প্রকাশিত ওই ‘তুচ্ছ’ খবরটি অনেকেরই নজর এড়িয়ে গিয়েছে।
জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে নারীজাতি আজ নাকি বিজয় পতাকা উড়িয়ে চলেছে আরও উত্তরণের দিকে। নির্বিচার নারীহত্যার সেইসব বিগত দিনের ইতিহাস এখন কাল্পনিক গালগল্প বলে মনে হয়। আমরা আপ্রাণ ভুলে যেতে চাই সেইসব কালিমালিপ্ত অতীত। কেন না আমরা বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে নানাবিধ প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করার স্বপ্ন দেখি। তাই অনেক নির্মম, রূঢ় ঘটনা, অনেক ঘৃণ্য বাস্তবকে সন্তর্পণে ঠেলে চালান করে দিই কার্পেটের তলায়। তবুও মাঝে-মধ্যে সরকারি বিজ্ঞাপণ ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ শ্লোগানটিকে ঘিরে একটু খটকা লাগে । তা হলে কি বেটিদের বাঁচতে কোথাও অসুবিধা হচ্ছে? পড়তেও?
বাস্তবে তো বেটিরা এখনও সমাজের চোখে পণ্য বই আর কিছু নয়! মুষ্ঠিমেয় কিছু মানুষ ছাড়া দেশের অধিকাংশ মানুষের কাছে মেয়ে সন্তান এখনও কাঙ্খিত নয়। মেয়ে পাচারের রমরমা চলছে দেশ জুড়ে। মেয়েদের জীবনের কী অদ্ভুত রসিকতা–তারা সন্তান হিসেবে অনাকাঙ্খিত, আবার ভোগ্যপণ্য হিসেবে তাদের চাহিদা তুঙ্গে। সেক্স ট্রেড সারা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি লাভজনক ব্যবসা।
কত না প্রবাদ প্রবচন মেয়েদের নিয়ে। তার মধ্যে সেরা সম্ভবত, ‘মেয়ের নাম ফেলি, পরকে দিলেও গেলি, যমকে দিলেও গেলি।’ পরকে দিতে গেলে কিছুদিন পালপোষ করতে হয়, তাই বেশি বুদ্ধিমানরা আঁতুড়েই গলা টিপে বা নদীতে ফেলে এসে মৃত সন্তানের গল্প চাউর করে দিত। যারা বেঁচে থাকতো, তাদের তুলনা করা হতো মাথার ছেঁড়া চুলের সঙ্গে। পাঁচ-ছয় বছর বয়স না হতেই পাত্র সন্ধান, দশের মধ্যেই বিড়াল পার। না হলে নাকি পিতৃকুল ও মাতৃকুলের চোদ্দপুরুষ নরকস্থ হবে। সুতরাং দাও কচি কন্যা বলি।
আসলে কন্যাসন্তান যতদিন মানুষের কাছে কাঙ্খিত না হবে, মানুষ যতদিন কন্যার মূল্য না বুঝতে পারবে, ততদিন কোনও স্লোগানই তাদের বাঁচাতে পারবে না।
যুগ সত্যিই বদলে গিয়েছে। মানুষ এখন আর ওইসব প্রিমিটিভ পদ্ধতিতে এত ঝামেলা আর নিষ্ঠুরতা করতে চায় না। আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যাণে গর্ভাবস্থার প্রাথমিক পর্বেই ভ্রূণের লিঙ্গ জেনে সমূলে বিনাশ করা কয়েক মিনিটের ব্যাপার। সেই কুকর্মটি এত ব্যাপকভাবে শুরু হ’ল যে, আদালত হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হ’ল। আদালতের আদেশানুসারে সন্তানসম্ভবা নারীর গর্ভস্থ ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ পরীক্ষা দণ্ডণীয় অপরাধ হিসেবে পরিগণিত হ’ল। আইনের বাধ্যবাধকতায় তাই প্রতিটি হাসপাতাল, নার্সিং হোমের সামনে এই মর্মে বড় বড় বিজ্ঞপ্তি ঝোলানো থাকে। তা সত্ত্বেও যে এক শ্রেণির অসৎ চিকিৎসক টাকার লোভে যে এ কাজ করে চলেছেন, তা বারবার প্রমাণিত হয়েছে।
কন্যাসন্তানের সংখ্যা কমতে কমতে স্বাভাবিক অনুপাত কমে ১০০০: ৯২৩-এ দাঁড়িয়েছে। এ ভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে মানবসমাজ যে ভয়ংকর সংকটের সম্মুখীন হবে, তা বলাই বাহুল্য। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, সেই সংকট শুরু হয়ে গিয়েছে। সামাজিক-অর্থনৈতিক এবং মূল্যবোধের অবক্ষয়জনিত কারণে এই অতি আধুনিকতার গর্ব করা সমাজের বুকে অহরহ ঘটে চলেছে নারী সংক্রান্ত ভয়ংকর সব অপরাধের ঘটনা। বেড়ে চলেছে মেয়েদের উপর অত্যাচারের মাত্রা। মেয়েদের সংখ্যা নিদারুণ ভাবে হ্রাস পাওয়ায় ইতিমধ্যেই কয়েকটি রাজ্যে বিয়ের জন্য কনের অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে। ভিন রাজ্য থেকে গরিব পরিবারের মেয়েদের কিনে এনে তাদের বিয়ে করতে বাধ্য হচ্ছে বহু পুরুষ। আর এই কেনাবেচার পথ ধরেই ঢুকে পড়েছে নারী পাচারকারীরা। গ্রামগঞ্জ থেকে প্রতিনিয়ত হারিয়ে যাচ্ছে অসংখ্য মেয়ে। বিয়ের নাম করে দালালরা তাদের কিনে নিয়ে মোটা টাকায় পতিতাপল্লিতে বিক্রি করে দিচ্ছে। মাঝে-মধ্যে এইসব আড়কাঠিদের পিছনে সমাজের প্রভাবশালীদের উপস্থিতিও টের পাওয়া যায় সংবাদপত্রের কল্যাণে।
এই প্রেক্ষাপটে ‘বেটি পড়াও, বেটি বাঁচাও’ স্লোগান কারা বাস্তবায়িত করবে? আসলে কন্যাসন্তান যতদিন মানুষের কাছে কাঙ্খিত না হবে, মানুষ যতদিন কন্যার মূল্য না বুঝতে পারবে, ততদিন কোনও স্লোগানই তাদের বাঁচাতে পারবে না। কন্যাই একদিন নারী হয়, সে-ই গর্ভে ধারণ করে মানবপ্রজাতিকে, ধরিত্রীর মতোই সে ধরে রাখে পরিবার, সমাজ। এই উপলব্ধি ছাড়া মানব সভ্যতা বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না।