কথায় বলে– লাইফ বিগিন্স অ্যাট ফরটি। অর্থাৎ বয়স শুরু হয় চল্লিশে। আর বর্তমান চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতি ও সামাজিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এই সময়কে বলা যায় গোল্ডেন মোমেন্টস। তাই এই সময়কে পাহাড়ের চূড়া বলে না ভেবে নতুন কিছু শুরু করার জন্য তৈরি হোন। এ জন্য এই বয়সটাই আদর্শ। এ সময়ে তাই কী খাবেন আর কীভাবে জীবন কাটাবেন, সে বিষয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন কেপিসি মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল ডায়েটেটিক্স অ্যান্ড কমিউনিটি নিউট্রিশনের বিভাগীয় প্রধান রঞ্জিনী দত্ত। তাঁর সঙ্গে কথা বললেন শ্যামলী বন্দ্যোপাধ্যায়।
আগে ধারণা ছিল, ৪০ বছর বয়স মানে মধ্য বয়সের প্রবেশ দ্বার। এই সময়ে পেরিমেনোপজ অর্থাৎ মেয়েদের শরীর মেনোপজের দিকে একটু করে এগোতে থাকে। তবে এখন মানুষের গড় আয়ু অনেক বেড়ে গিয়েছে। ৫০-এর আগে মধ্য বয়স ধরা হয় না। পেরিমেনোপজও ৪৫ বছরের আগে শুরু হয় না। আর ৪০ বছর বয়স এখন লেট ইউথের মধ্যেই পড়ে। কাজেই পরবর্তী জীবন ভালোভাবে কাটানোর এটাই সেরা সময়। এ জন্য নজর দিতে হবে স্বাস্থ্যকর খাওয়াদাওয়া ও কিছু শরীরচর্চার দিকে।
ত্বকের দিকে নজর
শারীরিক নিয়মে ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে এই বয়স থেকে বোন মিনারেল ডেনসিটি কমতে থাকে। কমতে থাকে ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ডি, ম্যাগনেশিয়ামের পরিমাণ। এ সময় থেকে ত্বকেও কিছু সমস্যা হয়। যেমন ত্বকের ঔজ্জ্বল্য, নমনীয়তা কমে যেতে শুরু করে, বলিরেখা পড়ে, চুলের ঘনত্ব কমতে থাকে, মাসলগুলো দুর্বল হতে শুরু করে। যদিও ত্বকের সমস্যার জন্য অনেক সময়ে দূষণেরও খুব বড় ভূমিকা থাকে। এ সময়ে তাই দরকার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এ জন্য খাবারে ভিটামিন এ, সি থাকা খুবই দরকার। কারণ এ সব উপাদান অ্যান্টি অক্সিডেন্ট হিসেবে ভালো কাজ করে। ভিটামিন এ পাওয়া যায় লাল, নীল গাঢ় সবজি ও ফলে। খাওয়া দরকার পালং শাক, টম্যাটো, গাজর, বেলপেপার ইত্যাদি। অন্যদিকে, ভিটামিন ই পাওয়া যায় নানারকম তেলে, বিশেষত রাইস ব্রান অয়েল, ক্যানোলা অয়েল ও ব্রাউন নাট অয়েলে। আর ভিটামিন সি পাওয়া যায় নানারকম ফল, আলু, কাচালংকা, পাতিলেবু ইত্যাদিতে যা সাধারণত আমরা রোজকার জীবনে খাই, সে সব আর বাদ দেওয়া চলবে না।
দুধ ভুলে দুধজাত খাবারে মন
এই বয়স থেকে কিছু হরমোন ও এনজাইম যেগুলো ছোটবেলায় কাজ করে, সেগুলো কমতে থাকে। অন্যদিকে, বাড়তে থাকে নেগেটিভ নাইট্রাইট। শরীরে তৈরি হয় রিঅ্যাক্টিভ অক্সিজেন স্পিসিস বা আরওএস। এই রিঅ্যাক্টিভ অক্সিজেন স্পিসিস অ্যান্টি অক্সিডেন্টের কাজে বাধা দেয়। ফলে চামড়া কুঁচকে যাওয়া থেকে শুরু করে বয়সের ছাপ ত্বকে পড়তে থাকে। আরওএস বাড়াতে সাহায্য করে মাংস। তাই নাইট্রাইট কমানোর জন্য মাংস খাওয়া কমিয়ে দিয়ে বেশি করে সবজি খাওয়া শুরু করতে হবে। ধীরে ধীরে নিরামিষ খাবারের পরিমাণ বাড়াতে হবে। ছোটবেলায় দুধ একটা খাবার হিসেবে কাজ করে। কিন্তু বড় বয়সে তার কোনো দরকার হয় না। তাই দুধ হজম করার জন্য দরকারি এনজাইমগুলোও এই বয়সে কমে যায়। এই কারণে ৪০-এর পর ল্যাকটোজ নেই এমন দুধজাত খাবার খেতে হবে। এর ফলে ক্যালসিয়ামের চাহিদা মিটবে। আবার ল্যাকটোজ থেকে কোনও সমস্যাও হবে না।
সরল শর্করার বদলে জটিল শর্করা
৪০ বছর বয়সের পর থেকে কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা জাতীয় খাবার কমানো দরকার। সাধারণত এই বয়সের পর থেকে কোমর্বিডিটির চান্স বেড়ে যেতে থাকে। ফলে একে একে হাজির হতে থাকে ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন ইত্যাদি। তাই এই সময় থেকে একটু করে জটিল শর্করার পরিমাণ বাড়িয়ে সরল শর্করার পরিমাণ কমাতে হবে। ভাতের বদলে ওটস, ব্রাউন রাইস, রুটি খাওয়ার দিকে ঝুঁকতে হবে। আসলে এই বয়সে আমাদের জীবনযাপনে একটা বড়সড় পরিবর্তন আসার জন্য কায়িক শ্রম অনেক কমে যায়। চাকরিজীবীদের যেমন কাজের ক্ষেত্রে একটা স্থিতিশীল অবস্থা আসে। ছুটোছুটি করে কাজ করার বদলে ডেস্ক ওয়ার্ক বা বসে কাজ করতে হয়। বাড়তে থাকে ওজন বাড়ার সমস্যা। তেমনি হোম মেকারদেরও বাচ্চারা বড় হয়ে যায়। তাদের পিছনে আর তেমন দৌড়াদৌড়ি করতে হয় না। সব মিলিয়ে অনেকটা স্থিতাবস্থা আসে। যদিও উভয় ক্ষেত্রেই কায়িক শ্রম কমলেও বাড়তে থাকে মানসিক শ্রম। মানসিক শ্রম লাঘবের জন্য এ সময়ে অবশ্যই ফ্যাটি অ্যাসিডযুক্ত খাবার খাওয়া দরকার। যেমন–ফিস অয়েল, আমন্ড, ওয়ালনাট ইত্যাদি ডায়েটে রাখা দরকার। কারণ, এই সব খাবার আমাদের চিন্তাধারা বাড়াতে সাহায্য করে। এছাড়া মেয়েরা আর কয়েকবছর পর যেহেতু মেনোপজের দিকে এগোতে থাকে, তাই এই সময় থেকে আইসোফ্লেভান পাওয়া যায় তেমন খাবার যেমন সয়াবিন, ছোলা, বিনস ইত্যাদি খাওয়া দরকার। এই খাবার ছেলেদের জন্যও সমান জরুরি।
খাবারের সঙ্গী করুন শরীরচর্চা
ডায়েটের পাশাপাশি যোগাসন বা আরোবিক্সও শুরু করা দরকার। সত্যি বলতে কী, এই বয়সে সবার জীবন মোটামুটি একটা রিল্যাক্স ফেজে থাকে। নতুন কিছু শুরু করা যায়। ফিটনেস বা খাওয়াদাওয়া– যে কোনও সু-অভ্যাস এই বয়সে গড়ে তোলা সম্ভব। এরপরে আরও বয়স বেড়ে গেলে, তা করা যায় না। তাই আগামী দিনগুলোর কথা ভেবে জীবনটাকে নতুন করে গড়ে তোলার আদর্শ সময় হল ৪০ বছর বয়স।