নেতারা কি জানেন প্রান্তিক মেয়েদের কথা?

ছবি–সংগৃহীত

চারদিকের প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করেই গরিব ঘরের মেয়েরা স্বপ্নের বাস্তবায়ন করতে চায়। লিখছেন সফিউন্নিসা

বছরের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর দেখা গেল অজ গ্রামের বেশ কিছু ছেলেমেয়ে খুব ভালো ফল করেছে। বিশেষ করে প্রান্তিক সমাজের হতদরিদ্র পরিবারের সন্তানদের কেউ সবজি বিক্রি করে, কেউ জুতো সেলাই করে নিরন্ন পরিবারের মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করেও লেখাপড়া চালিয়ে গিয়েছে বহু কষ্টে। এখন তাদের সামনে এই ‘উত্তীর্ণ’ হওয়াটাই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, এর পরের পর্বে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য তাদের নেই।

    বেশ কয়েক বছর ধরে দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী সমাজ-নির্ধারিত তথাকথিত অনভিজাত সম্প্রদায়ের পরিবারগুলির মধ্যে একটা ইতিবাচক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে । এদের ছেলেমেয়েরা স্বপ্ন দেখতে শিখছে। কোনও শর্টকাট পদ্ধতিতে নয়, এরা সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন করতে চায় চারদিকের প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করেই। দুর্ভাগ্যের বিষয়, শুধুমাত্র সুযোগ আর অর্থের অভাবে কিছুদূর যাওয়ার পর এরা থেমে যেতে বাধ্য হয়। এ বারের উচ্চমাধ্যমিকে সেই মেয়েটির কথা কি সভ্য সমাজকে ভাবাবে না যে, নিজে অ্যাসিড আক্রান্ত হয়েও কী অদম্য মনোবল নিয়ে উত্তীর্ণের তালিকায় সসম্মানে নিজের জায়গা করে নিয়েছে? সেই মেয়েটির কথা কেউ ভাববে না যে সারাদিন কুঁজো হয়ে বসে বিড়ি বেঁধে সংসারে অন্ন-সংস্থানের ব্যবস্থা করেও স্বপ্নটাকে মরতে দেয়নি?

    কোনও নেতা-নেত্রীকে তো এদের নিয়ে কিছু করতে দেখা যায় না! তাঁরা বরং কোনও তরুণীর অস্বাভাবিক মৃত্যুকে সাম্প্রদায়িক রূপ দেওয়ার  জন্য রাস্তা অবরোধ কিংবা আরও বড় কিছু ধামাকা তৈরির জন্য বেশি উৎসাহী। পিছিয়ে পড়া সমাজের যে মেয়েরা নিরলস পরিশ্রম করেও লেখাপড়ার ‘আশা’ পোষণ করে চলে, একটুখানি সুযোগ পেলে বর্তে যায়, তাদের সামনে তালাক বিরোধী আইন পাশের বর্ষপূর্তি পালন করার দৃষ্টান্ত তুলে ত্রাতা হয়ে উঠতে চায় সেই নেতা-নেত্রীদের অনেকেই।

    সমস্যা হচ্ছে, মানুষকে বিশেষ করে প্রান্তিক সমাজকে কিছুমাত্র জানার চেষ্টা না করে, মনের গভীরে তাদের প্রতি তাচ্ছিল্য বা ঘৃণা পোষণ করে ভোটের তাস হিসেবে তাদের ব্যবহার করার ট্রাডিশন বছরের পর বছর চলছে। তাই প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে কিছু প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও উচ্চ বিদ্যালয় কাছাকাছি থাকে না। যেখানে থাকে সেখানে ছাত্ররা কায়ক্লেশে পৌঁছতে পারলেও ছাত্রীরা পারে না শারীরিক ও নিরাপত্তার কারণে। তা ছাড়া গ্রামীণ বহু উচ্চ বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনার ব্যবস্থা থাকে না। কলেজ পর্যন্ত আর পৌঁছতে পারে তাদের ক’জন?

‘‘বহু তথাকথিত ডিগ্রিধারী যখন ভ্রান্ত রাজনীতিতে গা ভাসিয়ে বিবেকবুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে অমানবিক কাজে নিজেদের নিয়োগ করে স্বার্থসিদ্ধি করে, তখন সেই শিক্ষা হয়ে দাঁড়ায় ‘শিক্ষিতের শয়তানি’ যা ব্যক্তি, সমাজ সবার কাছেই ক্ষতিকর। যা ডেকে আনে সভ্যতার সংকট। ’’

    অর্থবানরা অবশ্যই পিছিয়ে থাকেন না। মফসসলে পেয়িং গেস্ট রেখে ছেলেদের, কম সংখ্যক হলেও, মেয়েদেরও উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করে থাকেন। কিন্তু দরিদ্রের ‘আশা’ অধরাই থেকে যায়। বিশেষ করে তাদের মেয়েদের আর উত্তরণ হয় না। আমাদের শ্রদ্ধেয় সরকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মেয়েদের জন্য খুব আবেগ-উদ্বেল হয়ে তড়িঘড়ি কী সুন্দর তালাকবিরোধী আইন পাশ করিয়ে ফেলল। এই আবেগের একাংশও যদি এই সমাজের মেয়েদের শিক্ষিত করে তোলার জন্য ব্যয় করত, সার্বিকভাবে লেখাপড়ার সুযোগের একটু ব্যবস্থা যদি করত, তা হলে এত হই চই করে আইন সংশোধনের ব্যবস্থা করতে হত না। এই সমাজের শিক্ষিত হয়ে ওঠা মেয়েরাই এ ব্যাপারে বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলত। পুরুষরাও উদ্যোগী হয়ে নিজেরাই প্রথাটাকে বিলুপ্ত করে দিত।

    আসলে, শিক্ষা যে চেতনা আনে, সে বিষয়ে বিলক্ষণ ওয়াকিবহাল রাজনীতির কারবারিরা। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ শিক্ষিত হলে বিপদ তাদেরই, যারা জনগণের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খায়। অনেকেরই তো জারিজুরি ছাড়া মূলধন কিছু নেই। অবশ্য লেখাপড়ার ডিগ্রি থাকলেই যে একজন মানুষকে শিক্ষিত বলা যাবে, এমনও নয়। সে উদাহরণও আমাদের চারপাশে। তাই বলতেই হয় যে, বহু তথাকথিত ডিগ্রিধারী যখন ভ্রান্ত রাজনীতিতে গা ভাসিয়ে বিবেকবুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে অমানবিক কাজে নিজেদের নিয়োগ করে স্বার্থসিদ্ধি করে, তখন সেই শিক্ষা হয়ে দাঁড়ায় ‘শিক্ষিতের শয়তানি’ যা ব্যক্তি, সমাজ সবার কাছেই ক্ষতিকর। যা ডেকে আনে সভ্যতার সংকট।

    যুগ যুগ ধরে চলে আসা অন্ত্যজ মানুষের প্রতি শিক্ষার বঞ্চনা নিয়ে  তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘শিক্ষার বাহন’ প্রবন্ধে লিখেছেন–‘‘শিক্ষার জন্য আমরা আবদার করিয়াছি, গরজ করি নাই। শিক্ষাবিস্তারে আমাদের গা নাই। তার মানে শিক্ষার ভোজে নিজেরা বসিয়া যাইব, পাতের প্রসাদটুকু পর্যন্ত আর কোনো ক্ষুধিত পায় বা না পায় সেদিকে খেয়ালই নাই। এমন কথা যারা বলে, নিম্ন সাধারণের জন্য যথেষ্ট শিক্ষার দরকার নাই, তাতে তাদের ক্ষতিই করিবে, তারা কর্তৃপক্ষদের কাছ হইতে এ কথা শুনিবার অধিকারী যে, বাঙালির পক্ষে বেশি শিক্ষা অনাবশ্যক, এমন-কি, অনিষ্টকর। জনসাধারণকে লেখাপড়া শিখাইলে আমাদের চাকর জুটিবে না, এ কথা যদি সত্য হয়, তবে আমরা লেখাপড়া শিখিলে আমাদেরও দাস্যভাবের ব্যঘাত হইবে এ আশঙ্কাও মিথ্যা নহে।’’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here