আসল ক্ষতি কোথায় লিখছেন সফিউন্নিসা
প্রায় তিনমাস হয়ে গেল অবসরে আছে দেশবাসী। আমরা ছুটিপ্রিয় জাতি। বিশেষ করে বাঙালিরা। বছরের শুরুতে নতুন ক্যালেন্ডার হাতে আসামাত্র আমরা প্রথমেই গুনতে শুরু করি ক’টা ছুটি রোববারের আগে পড়েছে, কোনও পাওনা ছুটি রোববারের দিনে পড়ে বরবাদ হয়ে গেল কিনা, তখনই প্ল্যান ছকা শুরু হয়ে যায় কোন ছুটিতে কোথায় বেড়াতে যাওয়া যায়।
কোথা থেকে এক উটকো ভাইরাস এসে সব ওলোট-পালোট করে দিল। লকডাউন আর অচেনা এক আতঙ্ককে সঙ্গী করে ঘরবন্দি অসহ্য জীবনযাপন শেষে আরও বেশি আতঙ্ক নিয়ে আনলক ওয়ান-এ আমরা সরকার নির্দেশিত সাবধানতা অবলম্বন করে কর্মক্ষেত্রে রওনা হলাম। প্রথমদিনেই মালুম হল, প্রায় তিনমাসের সাবধানতা এক মুহূর্তে ধূলিস্যাৎ হল। যানবাহনের অপ্রতুলতা আমাদের বাধ্য করল নিরাপদ দূরত্বের নিয়ম ভেঙে ফেলে ভিড় বাসে উঠে কর্মস্থলে যেতে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণ আরও বাড়বে। ভয়াবহ রূপ নিতে পারে আগামী কয়েকমাসে। কোনও কথাই কি আমাদের সচেতন করতে পারছে না?
এর পরের দৃশ্য তো আরও ভয়াবহ। আনলক মানে আমজনতা ধরেই নিয়েছে কোভিড -১৯ ভয় পেয়ে পিটটান দিয়েছে। সুতরাং মা ভৈঃ। চলো বাজার, দোকান, শপিং মল। লোকাল ট্রেন না চললে অফিসযাত্রীরা খুলে যাওয়া অফিসে আসবে কী করে? এ বার সেই পথেই ভাবনাচিন্তা চলছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ করোনা-পূর্ব স্টেজের মতো আনলক-ওয়ান পর্বে দৈনন্দিন জীবনযাত্রা শুরু করতে চলেছে। কিন্ত কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা উল্কাগতিতে বাড়ছে। প্রতিদিন সারাদেশে সহস্রাধিক মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। রাজ্যও পিছিয়ে নেই।
সব দেখে মনে হয় মানুষ সত্যিই আজ বিভ্রান্ত। তা না হলে এত উল্লাস, ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’ ভাবভঙ্গী আসে কীভাবে? একশ্রেণির মানুষের বেপরোয়া চলাফেরা—মাস্ক নেই, গ্লাভসের বালাই নেই, মোড়ে মোড়ে আড্ডার ছবি কী দ্রূত ফিরে এসেছে! বিশেষ করে মলগুলির সামনে জোড়ায় জোড়ায় আড্ডা—কারও মুখে মাস্ক নেই। ইয়ং জেনারেশনের এই বেপরোয়া ভাবভঙ্গী আতঙ্কিত করে তুলছে। এদের তো না জানার কথা নয় যে, রাজ্যের কোভিড হাসপাতালগুলিতে আর ঠাঁই দেওয়ার জায়গা নেই। কোভিড আক্রান্তের চাপে চিকিৎসকরা দিশাহারা, দিনরাত চিকিৎসার বাধ্যবাধকতায় তাঁদের অনেকে অসুস্থ। কেউ কেউ কোভিড আক্রান্ত হয়েছেন। মৃত্যুও হয়েছে কয়েকজনের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণ আরও বাড়বে। ভয়াবহ রূপ নিতে পারে আগামী কয়েকমাসে। কোনও কথাই কি আমাদের সচেতন করতে পারছে না?
কোভিড-পর্বের এই চারমাস আমরা কী করলাম? প্রথম কয়েকদিন আতঙ্কে ভুগলাম। দিন পনেরো পরেই শুরু হ’ল চোর-পুলিশ খেলা, ছুটির আমেজে বাজার করতে যাওয়ার বহর, প্রিয় রেসিপির সচিত্র বর্ণনা ফেসবুকে পোস্ট করা। এখানেই থেমে থাকার মতো বান্দা আমরা নই। এত নিরামিষ আনন্দ কি জীবনে উত্তেজনা যোগান দিতে পারে? দুর্বলের উপর অত্যাচার, টিজিং–এ সব না থাকলে জীবন তো বিস্বাদ! প্রথমেই তাই পাড়ায় বাস করা কোভিড হাসপাতালের নার্সরাই হলেন সফ্ট টার্গেট। তাঁদের সম্বোধন করা শুরু হল ‘করোনা’ নামে। বাজারে গেলে তাঁদের উদ্দেশে নোংরা নানা মন্তব্য, থুতু ফেলে ঘৃণা প্রকাশ করা, বাড়িওয়ালাদের উঠে পড়ে লাগা তাঁদের তাড়ানোর জন্য, এমনকী ডিউটি শেষে ফিরে নিজের বাড়িতেও তাঁদের ঢুকতে বাধা দেওয়া– এ সব তো জোরকদমে চালিয়ে গিয়েছি আমরা! না, এখানেই শেষ নয়, সুস্থ হয়ে ফিরে আসা প্রতিবেশীকে কী নির্মমভাবেই না আমরা পাড়ায় ঢোকা বন্ধ করতে যথাশক্তি ব্যয় করেছি!
অতিমারি আমাদের কোনও ইতিবাচক শিক্ষাই দেয়নি, বরং করে তুলেছে আরও হিংস্র, বিবেকহীন আর অশিক্ষিত। করে তুলেছে চরম নিষ্ঠুর আর স্বার্থপর।