দু’দেশের সেনা সংঘর্ষে জড়ালেও প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর হাতেগোনা কয়েকটি জায়গার মধ্যে রয়েছে গলওয়ান উপত্যকা, যেখানে সীমান্ত নিয়ে নয়াদিল্লি এবং বেজিংয়ের পার্থক্য বা বিবাদ কম রয়েছে। যখন পুরনো বিবাদ বাড়ছে, তখন চিনা বিদেশ মন্ত্রকের বিবৃতিকে নয়া জায়গায় ঝামেলা পাকানোর কৌশল হিসেবে দেখছে নয়াদিল্লি।
গত মঙ্গলবার সকালে দু’দেশের সেনার সংঘর্ষ নিয়ে সাউথ ব্লকের বিবৃতির কয়েক ঘণ্টা পরেই চিনা সেনার পশ্চিম থিয়েটার কম্যান্ড ঝ্যাং শুইলি প্রথম দাবি করেন, ‘গলওয়ান উপত্যকা এলাকার উপরে চিনের সার্বভৌমত্ব রয়েছে।’ অর্থাৎ গলওয়ান উপত্যকা নাকি বরাবর চিনের অংশ ছিল বলে তিনি দাবি করেন। একইসঙ্গে সেনা সংঘর্ষের দায় ভারতের উপর চাপিয়ে অভিযোগ করা হয়, ভারতীয় সেনা প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা অতিক্রম করেছে। যদিও এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে ভারত। বরং চিনা সেনাই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা টপকেছে বলে জানিয়েছে নয়াদিল্লি।
প্রতিবেশীর ভিত্তিহীন দাবি যে কোনওভাবেই মেনে নেওয়া হবে না, তা বোঝাতেই বুধবার মধ্যরাত পেরিয়ে বিবৃতি জারি করেছে সাউথ ব্লক। তার আগে চিনা বিদেশমন্ত্রীর সঙ্গে ফোনালাপে ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শংকর জানিয়ে দেন, চিনের পরিকল্পিত এবং পূর্ব-নির্ধারিত পরিকল্পনার কারণেই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল গলওয়ান উপত্যকা। দু’দেশের সেনার সংঘর্ষ বেঁধেছিল। সেই প্রভাব দু’দেশের সম্পর্কে পড়বে। ভারতের এই হুমকি যে চিন বরদাস্ত করবে না, তা বেজিং পালটা বিবৃতি দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে। ভারতকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বেজিং জানায়, সীমান্ত পেরিয়ে চিনের এলাকায় ফের প্রবেশ করলে এবং একতরফা আগ্রাসী পদক্ষেপ করা হলে সীমান্ত পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।
অন্যপ্রান্তে কাশ্মীর উপত্যকায় পাকিস্তান সেনার সীমান্ত লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেই চলেছে। জঙ্গি দমনে ভারতীয় নিরাপত্তারক্ষীদের লড়াই চালিয়ে যেতেই হচ্ছে। তাতে থেমে নেই প্রাণহানি। এর মধ্যে গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো শান্ত লাদাখ সীমান্ত অশান্ত হয়ে উঠেছে। গলওয়াল-কাণ্ডের জেরে লাদাখে ভারত ও চিন সেনারা শক্তিবৃদ্ধি শুরু করেছে । সংঘাতের আবহ নিরসনে দু’ দেশের মেজর জেনারেল পর্যায়ের বৈঠকে সমাধান সূত্র অধরাই রয়েছে। এর মধ্যে নয়াদিল্লি ও বেজিংয়ের আস্ফালন থেমে নেই।
এই সময়ে গোটা বিশ্ব জূড়ে করোনা ভাইরাস অতিমারির আকার নিয়েছে। তাতে ভারতের মতো দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত। এর মধ্যে ভারত-চিন সম্পর্কের অবনতি কোনও মূর্খও চাইবে না। যদিও চিনের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সরব হয়ে ভারতে চিনাপণ্য বয়কটের ডাক দিয়েছে কেউ কেউ। ইতিমধ্যে, বিএসএনএল-কে চিনা পণ্য ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছে। রেলের একটি প্রকল্পে ৫০০ কোটির বরাত পাওয়া চিনের সংস্থার সঙ্গে চুক্তি বাতিলের পথে। কিন্তু দু’-একটি ছোটখাট সিদ্ধান্ত নেওয়া আর পুরো চিনকে বয়কট করার মধ্যে বিরাট পার্থক্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সব পদক্ষেপ একটি বিরাট সিদ্ধান্তের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ মাত্র। সামগ্রিকভাবে বিনা চিনে চলা কঠিন। কারণ তথ্যপ্রযুক্তি থেকে পরিকাঠামো, বিনোদন থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী— সব ক্ষেত্রে ছেয়ে রয়েছে চিন এবং তাদের দেশের পণ্য বা পরিষেবা। তাই আবেগের বশে চিনা পণ্য বর্জনের কথা বলা যতটা সহজ, অর্থনৈতিক দিক থেকে ততটা বাস্তবসম্মত নয়।
তবুও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ছাপ্পান্ন ইঞ্চি বুকের ছাতি ফুলিয়ে বলতেই হচ্ছে, ‘‘ভারত শান্তি চায়। কিন্তু কেউ প্ররোচনা দিলে, যে কোনও পরিস্থিতিতে তার উপযুক্ত জবাব দিতে ভারত প্রস্তুত।’’ আসলে ঘরোয়া রাজনীতিতে মোদীর ওপর চাপ বাড়ছে বলেই সীমান্তে মোদী সরকার যুদ্ধের আবহ জিইয়ে জিইয়ে রাখতে চাইছে? নাকি অতিমারির সুযোগ নিয়ে চিন ভারতকে বেকায়দায় ফেলতে চাইছে? সমাধানসূত্র খুঁজে বের করার দায়িত্ব দু’দেশের কূটনীতিকদের। দু’দেশের রাষ্ট্রনায়কদের। কাজেই প্ররোচনা নয়, শান্তির পথ হল আলোচনা।