কপালকুণ্ডলা আজ আর সেই মানবী নন

আজকের চেহারায় কপালকুণ্ডলা মন্দির ।

সাগরতটে যে স্থানে নবকুমার পরিত্যক্ত হয়েছিলেন, তারই অনতিদূরেই দরিয়াপুরে মন্দিরের নির্জনতা আজও মনকে আকৃষ্ট করে। অতীতকে মনে করিয়ে দেয়। লিখছেন অনিমেষ বসু সরকার ।

‘পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ?’ মকরসংক্রান্তি এলেই সাহিত্যরসিকদের মনে উঁকি দেয় প্রশ্নটি। সাগরতটে হারিয়ে যাওযা নবকুমারকে প্রশ্নটি করেছিলেন যিনি, সেই ‘কপালকুণ্ডলা’ আর নিছকই এক মানবী নন, ভক্তদের কাছে তিনি আরাধ্য দেবী হয়ে উঠেছেন।

    অধুনা পূর্ব মেদিনীপুর জেলার সদর শহর কণ্টাই, যা কাঁথি নামেও পরিচিত। ১৮৬০ সালের জানুযারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এখানকার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। সেইসময়ে তিনি লিখেছিলেন ‘কপালকুণ্ডলা’। ১৮৬৬ সালে প্রকাশিত তাঁর এই উপন্যাসটি এতটাই জনপ্রিয় যে, কাপালিকের সেই ‘বনদেবী’ কালক্রমে কপালকুণ্ডলা নাম নিয়েছেন। যিনি ভৈরবী, কাপালিকের আমল থেকেই তিনি পঞ্চমুণ্ডের আসনে বসে রয়েছেন বলেই কথিত রয়েছে। এই দেবীর কাছেই গঙ্গাসাগর ফেরত পথভ্রষ্ট সপ্তগ্রামের যুবক নবকুমারকে বলি দিতে চেয়েছিলেন কাপালিক। কিন্তু পারেননি। তাঁকে বাঁচিয়েছিলেন কপালকুণ্ডলা। কী ভাবে?

    কাপালিকের হাতে তখন বন্দি নবকুমার। বঙ্কিম লিখেছেন, ‘এমন সময় বালুকার উপর কোমল পদধ্বনি হইল–এ পদধ্বনি কাপালিকের নহে । নবকুমার নয়ন ফিরাইয়া দেখিলেন, সেই মেহিনী–কপালকুণ্ডলা। তাঁহার করে খড়্গ দুলিতেছে। কপালকুণ্ডলা কহিলেন, ‘‘চুপ! কথা কহিও না–খড়্গ আমারই কাছে–চুরি করিয়া রাখিয়াছি।’’ এই বলিয়া কপালকুণ্ডলা অতি শীঘ্র হস্তে নবকুমারের লতাবন্ধন খড়্গ দ্বারা ছেদন করিতে লাগিলেন। নিমিষ মধ্যে তাঁহাকে মুক্ত করিলেন। কহিলেন–‘‘পলায়ন কর, আমার পশ্চাত্ আইস; পথ দেখাইয়া দিতেছি।’’ এই বলিয়া কপালকুণ্ডলা তিরের ন্যায় বেগে পথ দেখাইয়া চলিলেন। নবকুমার লাফ দিয়া তাঁহাকে অনুসরণ করিলেন।’

    মনের মানুষকে বাঁচাতে যে খড়্গটি কপালকুণ্ডলা ‘চুরি’ করেছিলেন, সেটি পরবর্তী সময়ে কাপালিক খুঁজে পেয়েছিলেন কি না, তার কোনও উল্লেখ বঙ্কিমের লেখনীতে নেই। তবে নবকুমার ও কপালকুণ্ডলার বিয়োগান্তক পরিণতির আগে পর্যন্ত ওই  কাপালিক তন্ত্রসাধনায় মগ্ন ছিলেন। ‘কপালকুণ্ডলা’র কাহিনী থেকে তা জানা যায়। কাহিনীটির প্রেক্ষাপট রচনাকাল থেকে কমপক্ষে আড়াইশো বছর আগে। যে সময়ে গঙ্গাসাগর থেকে ফেরার পথে অধুনা কাঁথির নিকটবর্তী সাগরতটে হারিয়ে গিয়েছিলেন নবকুমার।

    তার পর বদলে গিয়েছে সমাজ। তাই তন্ত্রসাধনার অঙ্গ হিসাবে নরবলি আজ দণ্ডনীয় অপরাধ। তাই বলে দেবীর পুজোয় পশুবলি এখনও বন্ধ হযনি। জানালেন কপালকুণ্ডলা মন্দিরের সেবাইত শোভারানি পুরি। খড়্গটি দেখিয়ে তিনি বললেন–এটি দিয়ে নবকুমারকে বলি দিতে চেয়েছিলেন কাপালিক। দেবীর আসনের পাশেই রাখা রয়েছে খড়্গটি। পশুবলি দিতেই এই খড়্গটি এখনও ব্যবহৃত হয়। আর ওই কাপালিকই যে ভোলানাথ পুরি, তারও কোনও উল্লেখ বঙ্কিমের রচনায় নেই। শোভারানিদেবী অবশ্য নিজেকে ওই কাপালিকের বংশেরই বধূ বলে জানান। স্বামী নরেন্দ্রনাথ পুরির অবর্তমানে শোভারানিদেবীকেই মন্দিরের হাল ধরতে হয়েছে। সরকার মন্দিরের দিকে ফিরেও তাকায় না। তাই মন্দিরের সংস্কার করতে ভক্তরাই ভরসা। জানালেন সত্তরোর্ধ্ব ওই মহিলা।

             দেবী কপালকুণ্ডলা।

    মন্দিরটি ঘিরে যখন মনুষ্যবসতির কোনও চিহ্ন ছিল না, জঙ্গল ঘেরা গা ছমছমে সেই পরিবেশ এখন আর নেই। গড়ে উঠেছে জনবসতি। তবুও এখানে কপালকুণ্ডলার খোঁজে এসে কোনওভাবে কেউ হারিয়ে যেতেই পারেন। এ ক্ষেত্রে রাজ্য পর্যটন দফতরের দেওয়া কোনও পথনির্দেশিকা চোখে না পড়লেও, ‘পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ’ সেই রোমাঞ্চভরা জিজ্ঞাসার উত্তর দেবে আধুনিক প্রযুক্তি। তাই তো দিঘা ফেরত কপালকুণ্ডলা মন্দিরের পথ দেখিয়ে দিল জিপিএস অর্থাত্ গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম।

দেবী এখানে নিষ্ঠুর নন। তিনি প্রতিহিংসা চান না। আসলে আক্ষরিক অর্থেই দেবী হলেন মমতাময়ী। এ কারণেই ‘তুমি অধম–তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন’, মানুষের এই দৃষ্টিকে প্রসারিত করতে দেবী করুণা করেন। তাই তো হাড়িকাঠে নবকুমারের মতো কপালকুণ্ডলাকেও পেতে চাননি তিনি। দেবীর এমন করুণা থেকে বঞ্চিত নন তাঁর একালের ভক্তরাও।

    সড়ক পথে দিঘার সমুদ্র সৈকত থেকে কপালকুণ্ডলা মন্দিরের দূরত্ব প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার। আর মন্দারমণি থেকে চাউলখোলা হয়ে মন্দিরটি ২৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। কলকাতা থেকে সরাসরি মন্দিরটির দূরত্ব প্রায ১৬০ কিলোমিটার। আবার কাঁথি থেকে জুনপুট সমুদ্র সৈকত মাত্র ন’কিলোমিটার দূরে। এখান থেকে রসুলপুর হয়ে সহজেই পৌঁছে যাওয়া যায় দরিয়াপুরে। ওই রসুলপুরের মোড় থেকে সুবর্ণবিহার পর্যন্ত বিস্তৃত যে ‘বালিয়াড়ি’র বর্ণনা বঙ্কিমের রচনায় পাওয়া যায়, কালক্রমে তা অনেক দূরে সরে গিয়েছে। প্রাকৃতিক কারণেই এই পরিবর্তন বলে ভূবিজ্ঞানীদের অভিমত। তবে সাগরতটে যে স্থানে নবকুমার পরিত্যক্ত হয়েছিলেন, তারই অনতিদূরেই ওই দরিয়াপুরে মন্দিরটির নির্জনতা আজও মনকে আকৃষ্ট করে। অতীতকে মনে করিয়ে দেয়।

    দেবী এখানে নিষ্ঠুর নন। তিনি প্রতিহিংসা চান না। আসলে আক্ষরিক অর্থেই দেবী হলেন মমতাময়ী। এ কারণেই ‘তুমি অধম–তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন’, মানুষের এই দৃষ্টিকে প্রসারিত করতে দেবী করুণা করেন। তাই তো হাড়িকাঠে নবকুমারের মতো কপালকুণ্ডলাকেও পেতে চাননি তিনি। দেবীর এমন করুণা থেকে বঞ্চিত নন তাঁর একালের ভক্তরাও। তারই সাক্ষ্য বহন করছে মন্দিরগাত্রে সাঁটা একটি প্রস্তরফলক। কথিত আছে, ‘মনোবাঞ্ছনা’ পূরণ হওয়াতেই তারকনাথ মাইতি ও তাঁর স্ত্রী কাত্যায়নীদেবী বানিয়ে দিয়েছেন দেবীর প্রস্তরময়ী মূর্তি। ১৯২৩ সালে (বাংলা সন ১৩২৯) কাশীধাম থেকে সংগৃহীত মূর্তিটিকে মন্দিরে কাপালিকের সেই দেবী ভৈরবীর পিছনে একই আসনেই স্থাপন করা হয়েছে।

    অভিন্ন হলেও প্রস্তরময়ী দেবী এখানে কৃষ্ণবর্ণা। আর ধাতুর তৈরি কাপালিকের ওই ভৈরবী হলেন স্বর্ণবর্ণা। দু’টি মূর্তিকেই নানাভাবে সাজিয়ে রাখেন সেবাইতরা। তাই বস্ত্রপরিহিতা কৃষ্ণবর্ণের দেবীর চারহাত দেখা গেলেও স্বর্ণময়ীর মুখখানিই শুধু দৃশ্যমান। চারশো বছর পার হলেও এই দেবীর রূপের ঔজ্জ্বল্যে পড়েনি বিন্দুমাত্র ভাটা। দেবীর মিষ্টি হাসির মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে তাঁর মহিমা। রাজ্যের পর্যটন মানচিত্রে এই দেবীর মন্দিরকে দেখানো হয়েছে ঠিকই, তবে তা নামেই। অথচ, কণ্টাই ছুঁয়ে পৌঁছতে হয় দিঘা বা মন্দারমণিতে। প্রচারের আলোয় নেই বলেই অধিকাংশ ভ্রমণার্থীরা মন্দিরটিকে পাশ কাটিযে চলে যান। এমনটাই আক্ষেপ এলাকাবাসীর।  

ছবি : লেখক।

ভ্রমণের অভিজ্ঞতা যদি জানাতে চান, তা হলে লেখা ও ছবি পাঠান। ইউনিকোড বাঞ্ছনীয়। পিডিএফে পাঠাবেন না। ওযার্ড ফাইলে লিখুন ও পাঠান। ঠিকানা ও ফোন নম্বর দিতে ভুলবেন না। ই-মেল করুন– editor@thekolkataexpress.com  

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here