বাংলা ছবি নিয়ে আলোচনার শীর্ষে ‘অব্যক্ত’। জানাচ্ছেন শ্যামলী বন্দ্যোপাধ্যায়
এখন বাংলা ছবি বেশ ভালই তৈরি হচ্ছে। যদিও বেশিরভাগই সে ভাবে মনে দাগ কাটতে পারে না। তবে এই সময়ে যে বাংলা ছবি আলোচনার শীর্ষে তার নাম অব্যক্ত। পরিচালক অর্জুন দত্ত। আমাদের চেনা বিষয়কে এই ছবিতে তিনি অন্যভাবে চিনিয়েছেন। সহজভাবে সমসাময়িক করে পরিবেশন করায় এই ছবি দর্শকদের মন ছুঁয়ে যায়।
ছবির গল্প ইন্দ্র এবং তার মা সাথির মধ্যে দ্বন্দ্ব, টানাপড়েনকে কেন্দ্র করে। ছোট্ট ইন্দ্র ছোট থেকে মেয়েদের সঙ্গ পছন্দ করে। তাদের মতো পুতুলের বিয়ে দিতে ভালবাসে। মায়ের মতো শাড়ি, টিপ ও লিপস্টিক তার সাজার জিনিসের মধ্যে জায়গা করতে চায়। কিন্তু এ রকম সাজ দেখলেই মা রেগে যান, বকাবকি করেন। ইন্দ্রর তা মানতে অসুবিধা হয়। মায়ের সঙ্গে এর থেকেই একটু করে দূরত্ব তৈরি হতে থাকে। অন্যদিকে, তার বাবার বন্ধু রুদ্রর মতো সাহিত্য নিয়ে পড়া ও ছাত্রদের পড়ানোর ইচ্ছা দানা বাঁধে শিশু মনে। তা-ও একেবারে পছন্দ নয় মায়ের। শুধু তাই নয়, অজানা কারণে রুদ্রকে বাবার কাছে আসতে দেখলেই মায়ের রাগ হয়, সুন্দর মুখে তখন আগুন জ্বলে ওঠে, তা বুঝতে পারে না কচিমন। যদিও তার বাবা যে রুদ্রকে খুব বেশিরকম পছন্দ করেন, তা বুঝতে পারে ইন্দ্র। ছোট থেকে এ ভাবেই মায়ের সঙ্গে মনের ব্যবধান তৈরি হতে থাকে। বড় হয়ে ইন্দ্র বড় চাকরি নিয়ে দিল্লিবাসী হয়। কিছুটা অভিমান করেই মায়ের থেকে দূরে থাকতে চায়। দিল্লিতে অদিতি নামে মেয়ের সঙ্গে লিভ ইন করলেও সম্পর্ক তাকে বিয়ে করতে সাহস পায় না। কারণ মায়ের সঙ্গে তার মানসিক দূরত্ব কোথাও বাধা হয়ে দাঁড়ায় তাঁর বিবাহিত জীবনে প্রবেশের পথে। যদিও এক সময়ে মায়ের কাছে তাকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আসতে হয় সম্পত্তির আইনি ব্যবস্থার জন্য। এর পর এক ছাদের নীচে থাকতে থাকতে, বিভিন্নজনের কাছে মায়ের কথা শুনে সে আবিষ্কার করে মায়ের অন্য রূপ। তাঁর মনের কোণে ভিড় করে থাকা নানা প্রশ্ন… কেন ভালো গান জানা সত্ত্বেও মা গান গান না? কেন মা তাঁকে এত শাসন করতেন? মামাবাড়ি যাওয়াতেই বা মায়ের এত আপত্তি কীসের ছিল? ছোট্ট ছেলের মেয়ে সাজা বা খেলনাবাটিতে মায়ের আপত্তির উত্তর পেয়ে যায়। এ ভাবে এক সময়ে মায়ের ওপর জমে থাকা সব অভিযোগের উত্তর ব্যক্ত হয় তাঁর কাছে। এতদিনের অব্যক্ত বিষয় কীভাবে মা ছেলের দূরত্ব ঘুচিয়ে দেয়, সে বিষয় ছবিতে সুন্দরভাবে বলা হয়েছে।
আসলে এই ছবির কাহিনি বিন্যাসে আছে সারল্য ও সততা। এখনকার ছবিতে যৌন প্রবৃত্তির আলোচনা তেমন নতুন কিছু নয়। কিন্তু সেই বিষয় নিয়েই মা ও ছেলের বা স্বামী-স্ত্রীর অব্যক্ত বিষয় সুন্দর ভাবে দেখিয়েছেন পরিচালক। নিজের কাহিনি, চিত্রনাট্য নিয়ে নতুন পরিচালক একটা সম্পূর্ণ ছবি সবাইকে উপহার দিলেন। যে ছবির রেশ থেকে যায় প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়ে আসার পর বেশ কিছুদিন। ছবির কলাকুশলীদেরও পরিচালক খুব সন্তর্পণে নির্বাচন করেছেন। মূল চরিত্রে অর্থাৎ ইন্দ্র’র মায়ের চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছেন অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়। তাঁকে ঘিরেই আবর্তিত অন্য সব চরিত্র। যেমন ইন্দ্র (অনুভব কাঞ্জিলাল), রুদ্র (আদিল হুসেন), কৌশিক (অনির্বাণ ঘোষ)। এ ছাড়াও স্বল্প সময়ের জন্য পাওয়া পর্দায় পাওয়া গিয়েছে লিলি চক্রবর্তী, খেয়া চট্টোপাধ্যায়, দেবযানী চট্টোপাধ্যায় ও সামন্তকদ্যুতি বন্দ্যোপাধ্যায়কে। ছবিকে সর্বাঙ্গ সুন্দর করে তুলতে গান যোগ্য সঙ্গত দিয়েছে। রবীন্দ্র ঘরানা মেনে শুধু তানপুরা ব্যবহার করা হয়েছে গানে। দর্শক মনে দাগ কাটার যাবতীয় উপাদান মজুত ছিল বলেই এই ছবি দর্শকের মন জিতে নিয়েছে।