কোপাইয়ের কাছে

গাছের নীচে ঝরা পাতা যেন সোনালি গালিছা বিছিয়ে দেয়। তাই তো বনের নাম সোনাঝুরি। এখানেই বসে শনিবারের হাট । ঘুরে এসে অভিজ্ঞতার কথা জানাচেছন অনিমেষ বসু সরকার

রতের শিশির ভেজা সকাল। কিছুক্ষণ আগেই গণদেবতা এক্সপ্রেস হাওড়া থেকে প্রান্তিক স্টেশনে এসে থেমেছে। ট্রেন থেকে নেমে টোটোয় করে চলেছি সোনাঝুরি অতিথি নিবাসের দিকে। পথের একপাশে বিস্তীর্ণ ধানখেত। আরেক পাশে ঘন বন। অরুণ আলোয় কোথাও উঁকি দিচ্ছে কাশবন। আজ শনিবার। এই বনের মধ্যেই হাট বসবে। তাই সাঁওতালি ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে ব্যাপারীরা চলেছেন হাটের পথে।

চলার পথে মনের কোণে ভেসে ওঠে কবিগুরুর কথা–আমার ভাঙা পথের রাঙা ধুলোয় পড়েছে কার পায়ের চিহ্ন। কিন্তু এখন সেই রাঙাপথের বুকে পড়েছে পিচের আস্তরণ। এই পথ ধরে কিছুটা গেলেই সোনাঝুরির বন। অদূরে বয়ে চলেছে কোপাই। এই বনের মধ্যেই বসে শনিবারের হাট। জানান দিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পর্যটন বিভাগ। এ নিয়ে বিজ্ঞাপনী বোর্ডে কবিগুরুর ছবির পাশে লেখা–দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/একটি ধানের শিষের উপরে/একটি শিশির বিন্দু।

তাই বিজ্ঞাপনে দিক নির্দেশ। চলুন শান্তিনিকেতন। এখানে পা রাখার আগে সোনাঝুরির বনে তখন রৌদ্রছায়ার লুকোচুরি খেলা চলছে। মাথার ওপর পাঁজা তুলোর মতো মেঘের বিচরণ কবিগুরুকেই মনে করিয়ে দেয়। আসলে এখানকার আবহে প্রতিটি পরতেই রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে পাওয়া যায়। তিনিই তো লিখেছেন, ‘নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা।’ একসময়ে বনের গাছগুলো সোনালি রং নেয়। গাছের নীচে ঝরাপাতা যেন সোনালি গালিছা বিছিয়ে দেয়। তাই তো বনের নাম সোনাঝুরি। এখান থেকে আঁকাবাঁকা পথ গিয়ে মিশেছে শালবনে। শরতের রোদ পেয়ে পাতারা ঝকঝক করছে। দেখে মনে হল, আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ।

                  শনিবারের হাটে সাঁওতালি নাচ।

আবার এই বন প্রসঙ্গে কবিগুরু এক জায়গায় লিখেছেন–শ্যামল সুন্দর সৌম্য, হে অরণ্যভূমি/মানবের পুরাতন বাসগৃহ ভুবন। নিশ্চল নির্জীব নহ সৌধের মতন–তোমার মুখশ্রীখানি নিত্যই নূতন/প্রাণে প্রেমে ভাবে অর্থে সজীব সচল।

অরণ্যভূমির এই সজীবতা বেড়ে যায় ধামসা-মাদলের তালে। সাঁওতালি নাচের ছন্দে। আমার মতো অনেকেই এখানে এসেছেন অরণ্য-প্রকৃতির নির্যাস নিতে। এখানে আসব বলে সোনাঝুরির অতিথি নিবাসে আগে থেকেই ঘর বুক করে রেখেছিলাম। এখানে পৌঁছে মধ্যাহ্নভোজের পালা চুকিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সোনাঝুরির বনে শনিবারের হাটে তখন থিকথিক করছে ভিড়। তারমধ্যে কেউ কিনছেন হাতে বোনা নকশাকাটা শাড়ি অথবা সালোয়ার কামিজ। কেউ কিনছেন পাথর বসানো গয়না। আবার কেউ কিনছেন চামড়ার ব্যাগ অথবা ঘর সাজানোর সামগ্রী। কেনাকাটার ফাঁকে কেউ আবার সাঁওতালি মেয়েদের হাত ধরে একটু নেচেও নিচ্ছেন। এমনই একটি নাচের দলের মেয়েদের পরনে হলুদ-সবুজ শাড়ি। মাথায় পর পর পিতলের তিনটি কলসি সাঁটা। কলসির মাথায় ফুল গোঁজা। নাচের ফাঁকে একজন কথা প্রসঙ্গে জানায়, ‘‘আমরা বড় গরিব। তাই হাটে আসি নাচ দেখাতে। দিনের শেষে যা রোজগার হয়, তা নিয়ে ঘরে ফিরি।’’ শুধু সাঁওতাল পাড়ার ছেলে-মেয়েরাই নয়, হাটে বাউলেরাও আসে গান শোনাতে। কানে এল আপন মনে এক বাউল গেয়ে চলেছে–ওরে মন যখন জাগলি না রে/তখন মনের মানুষ এল দ্বারে। তার চলে যাবার শব্দ শুনে/ভাঙল রে ঘুম….।

কার কাছে শিখলে এই গান? ‘গৃহপ্রবেশে’র সেই বোষ্টমীর মতোই উত্তর এল, ‘‘গুরুদেব আমাকে গান জোগায়। যখন বলি শিখিয়ে দাও, শেখায়। এখানে আসি গান গাইতে। পেটের জ্বালায়। গান শুনে যাদের ভালো লাগে, তারা দশ-বিশ টাকা দেয়।’’ এ ভাবেই ইতিহাস তৈরি হয় বলেই হাটে ঘুরতে ঘুরতে রবীন্দ্রভাবনার বাণিজ্যকরণও চোখে পড়ল। দেখলাম কবিগুরুর নানা কবিতার লাইন ফ্রেমবন্দি করে বিক্রি হচ্ছে। তারই মধ্যে একটিতে খুঁজে পেলাম, যেখানে কবি লিখেছেন–হাটের ভিড়ের দিকে চেয়ে দেখি,/হাজার হাজার মুখ হাজার হাজার ইতিহাস,/ঢাকা দিয়ে আসে যায় দিনের আলোয় রাতের আঁধারে।

                      শনিবারের হাটে বাউল।

এই প্রেক্ষাপটে সূর্যাস্তের সঙ্গে সোনাঝুরির বনে ঘনিয়ে আসে গাঢ় অন্ধকার। ততক্ষণে অতিথি নিবাসে ফিরে এসেছি। আগের দিন ছিল বিজয়া। বনেরপুকুর ডাঙা আর বল্লভপুর গ্রামের সংযোগে এই অতিথি নিবাসে দুর্গাপুজো হয়। এ বারেও হয়েছিল। কিন্তু এখানে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয় না। সযত্নে রেখে দেওয়া হয়। শিল্পীর ভাবনায় দশভুজা এখানে প্রকৃতির দেবী। তাই দেবীর দশ হাতেই অস্ত্রের বদলে রয়েছে পদ্মফুল। পুজোর প্রধান হোতা কলকাতার সরকারি আর্ট কলেজের মাস্টারমশাই বাঁধন দাস। তাঁর দিদির নাম হীরা আর বাবা নলিনী দাস। এই দু’জনের নাম জুড়েই এখানকার পুজো ‘হীরালিনী দুর্গোত্সব’ বলে পরিচিতি পেয়েছে। ২০০১ সালে অকালেই চলে যান শিল্পী। তাঁর বোন চিত্রা ঘোষ জানান, ‘‘দাদা না থাকলেও প্রতি বছর আমরা পুজো করে আসছি। এই পুজো এখানকার গাঁয়ের মানুষের নিজেদের পরবের মতো। তাই পুজোর ক’টা দিন ঢাকির বাদ্যি আর মাদলের তাল এক হয়ে যায়।’’

রাত যত বাড়ে, অরণ্যের নির্জনতা তত গভীর থেকে গভীর হয়। রাতের খাওয়া-দাওয়ার পর ঘরে ঢুকে দেখি জানালা বেয়ে চাঁদের আলো এসে ঘরময় লুটোপুটি করছে। ঘরের আলো জ্বালাতে মন চাইছে না। ঘর থেকে বেরিয়ে ব্যালকনি থেকে আকাশ দেখছি। একঝাঁক তারার মধ্যে পূর্ণশশীর রূপ নিতে চলা মায়াবী আকাশ বলে দিচ্ছে ক’দিন বাদেই কোজাগরী লক্ষ্মীপূর্ণিমা। এদিক-ওদিক তাকাতেই চোখ পড়ে গেল ঘরের পাশে টবে ফোটা শালুক ফুলের দিকে। ফুলটির দিকে তাকিয়ে আছি। একসময়ে মনে হল আবছা আলোর ঘোমটা সরিয়ে লাজুক বধূর মতো ফুলটি যেন বলছে–রাত হয়েছে। এ বার শুতে যাও।

ঘরে ঢুকে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছি। কিন্তু ঘুম আসে না। শনিবারের হাটের ছবিগুলো মাথার মধ্যে কিলবিল করছে। ভাবছি, কখন সকাল হবে। কতক্ষণে কোপাইয়ের কাছে যাব। ভাবতে ভাবতে একসময়ে চোখ বুজে আসে। যখন ঘুম ভাঙল, তখন ঘরের বাইরে রোদ ঝলমল করছে। দেরি না করে প্রাত-রাশ সেরে তৈরি হয়ে নিলাম। অতিথি নিবাসের সামনেই পেয়ে গেলাম একটি টোটো। চলেছি কোপাইয়ের দিকে। টোটোটি আমি সারাদিনের জন্য রিজার্ভ করে নিয়েছিলাম। পিয়রসন সেতুর ওপর টোটো এসে থামল। নীচ দিয়ে নীরবে বয়ে চলেছে কোপাই। কবির কথায়, ‘আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে।’ ঐ সেতুর ঢাল দিয়ে নেমে তার পাড়ে এসে দাঁড়ালাম। দু’চোখ ভরে কোপাইকে দেখছি। চরার গ্রাসে সে আজ মৃতপ্রায়।

                  সোনাঝুরির বনে শনিবারের হাট।

এমন কোপাইকে দেখব, তা ভাবিনি। তাই তাকে দেখে যখন ফিরছি, তখন বুদ্ধদেব গুহ’র ‘অববাহিকা’ মনে করিয়ে দেয় সেই কবিতা। কোপাইকে নিয়ে লেখা–যতবার আঁকলাম,/মুছলাম তার চেয়ে বেশি। কল্পনার রং সংস্কৃতির তুলিতে বুলিয়ে/বুলিয়ে ফুরিয়ে এল,/তবু আঁকা হল না তোমাকে/তোমার মতন করে।

ভাবতে ভাবতে চলেছি প্রকৃতি ভবনের দিকে। সোনাঝুরি বন, খোয়াই আর বনেরহাট পেরিয়ে একটু এগিয়ে এলেই প্রাকৃতিক ভাস্কর্যের সংগ্রহশালা ‘প্রকৃতি ভবন’। এখানে আসার আগে সাঁওতালপল্লিতে একটি বাড়ির সামনে টোটো এসে দাঁড়াল। বাড়ি বলতে কুঁড়ে ঘর। চকচকে রাস্তার দু’পাশে গা জড়িয়ে থাকা সারিবদ্ধ রাঙামাটির তৈরি এইসব ঘর ঠিক যেন ক্যানভাসে আঁকা ছবির মতো দেখতে লাগছে। বেশিরভাগ বাড়ির ঘরের দেওয়ালে খোদাই করে তুলে ধরা হয়েছে সাঁওতালি জীবনযাত্রার নানা দৃশ্যপট, যা গবেষণার খোরাক জোগায়। যে বাড়িটির সামনে টোটোটি দাঁড়িয়ে তার দরজা খোলাই ছিল। টোটোচালক–এখানেই ‘ইষ্টিকুটুম’ সিরিয়ালের শুটিং হয়েছিল। তাতে এটাই ছিল বাহার বাড়ি। টোটো থেকে নেমে ঢুকে দেখি বাড়িতে কেউ নেই। কেন? সিরিয়ালের দৌলতে সকাল থেকে সন্ধ্যা এ বাড়িতে সোনাঝুরি ঘুরতে আসা লোকজনদের আনাগোনা লেগেই থাকে। তাই বাসিন্দারা বিরক্ত হয়ে ভিটে ফেলে অন্যত্র থাকছেন। বললেন টোটোচালক। শুনে অবাকই হলাম। ভাবছি, কী বিড়ম্বনা! বাড়িটি থেকে বেরিয়ে টোটোতে উঠতে যাব, তখনই আরেকটি টোটো এসে থামল। জনা ছয়েক ছেলেমেয়ে টোটোটি থেকে নেমে সটান বাহার বাড়িতে ঢুকে গেল।

বাড়িটির দৌলতে রূপপুর পঞ্চায়েতের অখ্যাত এই পল্লি যে পর্যটন মানচিত্রে জাযগা করে নিয়েছে, রাজ্যের পর্যটন দফতর তার খোঁজ রাখে কিনা, কে জানে। এখান থেকে প্রকৃতি ভবনে আসার পথে দু’দিকে কোথাও শাল, কোথাও সোনাঝুরির বন। অভ্রকুচির মতো রোদের টুকরো গাছের ফাঁকফোকর দিয়ে ঠিকরে যাচ্ছে চারদিকে। সূর্য তখন মধ্য গগনে। খিদের জ্বালা মেটাতে টোটো থামিয়ে রাস্তার ধারে গজিয়ে ওঠা আদিবাসীদের একটি হোটেলে ঢুকে পড়লাম। ওদের হাতের রান্নার স্বাদ আগের দিনই অতিথি নিবাসে পেয়েছি। এখানে নতুন করে সেই তৃপ্তির স্বাদ পেলাম। এরপর প্রকৃতি ভবনে এসে চোখ আটকে গেল ‘মত্স্যউর্বশী’কে দেখে। পথের সঞ্চয়কে পাথেয় করে যিনি এই সংগ্রহশালাটি গড়ে তুলেছেন, সেই সুব্রত বসুর কথায়, ‘‘গাছের শুকনো ডালে প্রকৃতির ভাস্কর্য হয়ে সে একদিন ধরা দিয়েছিল। এখন সে ব্রোঞ্জে রূপান্তরিত হয়ে কলকাতা বন্দর ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বাবুঘাটে স্রোতস্বিণী গঙ্গার পাড়ে স্থান পেয়েছে। এখানে সে শুধুমাত্র নৃত্যরতা মত্স্যপ্রাণের প্রতীক হয়ে ওঠেনি, বিবর্তনের ‘মেঘ, বৃষ্টি, রোদ্দুর’ যে অবিরত ছেনির আঘাতে ভাঙাগড়ার খেলায় নিমগ্ন, সেই ভাবনার রসদ জোগায়।’’

                           চরার গ্রাসে কোপাই।

প্রকৃতি ভবনে রয়েছে মনোরথের ডালায় সাজানো এমনই ভাবনার নানা অনবদ্য নিদর্শন। আর এই ভাবনার মধ্যেই নিহিত রয়েছে কবিগুরুর জীবনের সুর। বিশ্বভরা ‘প্রাণ’। যেখানে কবিগুরু লিখেছেন–এ আমার শরীরের শিরায়-শিরায়/যে প্রাণতরঙ্গমালা রাত্রি-দিন ধায়/সেই প্রাণ ছুটিয়াছে বিশ্বদিগ্বিজয়ে/দুলিতেছে অন্তহীন জোয়ার-ভাটায়। করিতেছে অনুভব সে অনন্ত প্রাণ/অঙ্গে অঙ্গে আমারে করেছে মহীয়ান। সেই যুগ যুগান্তের বিরাট স্পন্দন/আমার নাড়িতে আজ করিছে নর্তন।

প্রকৃতি ভবনের অঙ্গনে ‘মহাকাল’ ভাস্কর্যের পাদবেদিতে লেখা কবিগুরুর এই ভাবনায় ডুব দিয়ে চলে এসেছি ‘আমার কুটির’ দেখতে। বল্লভপুরে এই কুটিরের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের গ্রাম পুনর্গঠনের ভাবনা।  জড়িয়ে রয়েছেন সুষেণ মুখোপাধ্যায়, পান্নালাল দাশগুপ্তদের মতো স্বাধীনতা সংগ্রামীরা। সুভাষচন্দ্র বসু, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের পদধূলিধন্য এই কুটিরের প্রবেশপথটি বড়ই মনোরম। পথের দু’পাশে শালবন। রাঙামাটির পথ গিয়ে মিশেছে বৈপ্লবিক চিন্তাধারার প্রাণকেন্দ্র এই কুটিরে। এখানে গড়ে তোলা হয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামের নানা ইতিহাস নিযে সংগ্রহশালা। এখানকার স্লোগান লোকমান্য তিলকের সেই বিখ্যাত বাণী–‘স্বাধীনতা আমার জন্মগত অধিকার।’ কুটির চত্বরে রয়েছে ইকোট্যুরিজম পার্ক। রয়েছে নানা মাপের অতিথি নিবাস। গড়ে উঠেছে চর্ম ও বাটিকশিল্পের কর্মশালা। এখানকার নিজস্ব উত্পাদন ছাড়াও বিপণন কেন্দ্রটিতে রয়েছে  স্থানীয় হস্তশিল্পীদের তৈরি নজরকাড়া শিল্পসম্ভার। অনেকের মতো আমিও লোভ সামালাতে পারলাম না। পোড়ামাটির তৈরি ঘরসাজানোর একটি নিদর্শন কিনে চলেছি পুণ্যতীর্থ কঙ্কালিতলায়। এখানে মাথা ঠুকে ফিরে এলাম অতিথি নিবাসে।

                  কলকাতার বাবুঘাটে ‘মত্স্যউর্বশী’।

ইচ্ছে ছিল আরেকটি রাত সোনাঝুরির অতিথি নিবাসে কাটিয়ে বল্লভপুর অভয়ারণ্য দেখে আসব। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। কারণ, শান্তিনিকেতনে পশ্চিমবঙ্গ  সরকারের পর্যটন দফতরের অতিথিশালায় ঘর আগাম বুক করা ছিল। তাই সোনাঝুরির অতিথি নিবাস থেকে বিদায় নিতেই হল। এখান থেকে যে সব টোটো বোলপুর যাচ্ছে, তারই একটিতে চেপে চলেছি শান্তিনিকেতন। সোনাঝুরি থেকে শান্তিনিকেতন আড়াই কিমি দূরে। সূর্য তখন কোপাইয়ের কোলে ঢলে পড়েছে। চলার পথে দু’পাশের ছবি রবীন্দ্রভাবনাই উসকে দেয়–আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালিমালা। নবীন ধানের মঞ্জরী দিয়ে/সাজিয়ে এনেছি ডালা।

                 শান্তিনিকেতন আশ্রমে উপাসনা গৃহ।

একসময়ে মিলিয়ে যায় কাশবন, ধানখেত। খান খান হয়ে যায় সোনাঝুরির নির্জনতা। ঘনিয়ে আসে সন্ধ্যা। বোলপুর বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে এ বার রিকশায় চেপেছি। যাচ্ছি সরকারি পর্যটন আবাসে। এখানে রাত কাটিয়ে পরদিন কলকাতা ফেরার পালা। বোলপুর স্টেশন থেকে শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস ছেড়ে যাবে বেলা ১টায়। তাই সাতসকালেই পর্যটন আবাসের রেস্তরাঁয় গরম চায়ে চুমুক দিযে বেরিয়ে পড়লাম শান্তিনিকেতন  ঘুরতে।  নাম ছিল তার ভুবনডাঙা।  একদা সৃষ্টির সংকল্প নিয়ে শিলাইদহের পদ্মাতীর ফেলে কোপাইয়ের কাছে যখন কবিগুরু এখানে আসেন, তখন আশ্রমের পরিধি ছিল ছোটো। এখন তা অনেকটাই বিস্তৃত । সেই ‘আশ্রমের রূপ ও বিকাশ’ প্রসঙ্গে কবিগুরুর লেখা থেকে জানা যায়, তখন এখানকার দক্ষিণ সীমানায় ছিল দীর্ঘ সার-সার তালগাছ। মাধবীলতা-বিতানে ছিল প্রবেশদ্বার। পিছনে পূর্ব দিকে ছিল আমবাগান, পশ্চিম দিকে কোথাও-বা তাল, কোথাও-বা জাম, কোথাও বা ঝাউ, আর গুটিকয়েক নারকেল গাছ। উত্তরপশ্চিম প্রান্তে প্রাচীন দু’টি ছাতিমের তলায় মার্বেল পাথরে বাঁধানো একটি নিরলংকৃত বেদি। তার সামনে গাছের আড়াল নেই, দিগন্ত পর্যন্ত অবারিত মাঠ, সে মাঠে তখনও চাষ পড়েনি। উত্তর দিকে আমলকি বনের মধ্যে অতিথিদের জন্য দোতলা কোঠা আর তারই সংলগ্ন প্রাচীন কদমগাছের ছায়ায় রান্নাবাড়ি। আর-একটিমাত্র পাকা বাড়ি ছিল একতলা, তারই মধ্যে ছিল পুরোনো আমলের বাঁধানো তত্ত্ববোধিনী ও আরও কিছু বইয়ের সংগ্রহ। এই বাড়িটিকেই পরে প্রশস্ত করে ও এর উপরে আর-একতলা চড়িয়ে বর্তমান গ্রন্থাগার স্থাপিত হয়েছে। আশ্রমের বাইরে দক্ষিণের দিকে বাঁধ তখন ছিল বিস্তৃত ও জলে ভরা। তার উত্তরের উঁচু পাড়িতে বহুকালের দীর্ঘ তালশ্রেণি। আশ্রম থেকে দেখা যেত বিনা বাধায়। আশ্রমের পূর্ব সীমানায় বোলপুরের দিকে ছায়াশূন্য রাঙামাটির রাস্তা। সে রাস্তায় লোকচলাচল ছিল সামান্য। কেন না শহরে তখন ভিড় জমেনি, বাড়িঘর সেখানে অল্পই। ধানের কল তখনও আকাশে মলিনতা ও খাবারে রোগ ছড়াতে আরম্ভ করেনি। চারদিকে বিরাজ করত বিপুল অবকাশ, নীরব-নিস্তব্ধতা।

কালক্রমে শহরের পরিবেশটাই বদলে গিয়েছে। নগরায়নের ফলে চারদিকে গজিযে উঠেছে কংক্রিটের জঙ্গল। আর যানবাহনের কোলাহল তো লেগেই আছে। এ সব উপেক্ষা করেই কিছুক্ষণের মধ্যেই টোটো এসে থামল ছাতিমতলার প্রবেশদ্বারে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন রায়পুরের জমিদারবাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে আসছিলেন, তখন এই ছাতিমতলায় কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিয়েছিলেন। এখানে তিনি তাঁর ‘প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ ও আত্মার শান্তি পেয়েছিলেন। তার ফলস্বরূপ রায়পুরের জমিদার প্রতাপ নারায়ণের কাছ থেকে ২০ বিঘে জমি গ্রহণ করার পর এখানে একটি বাড়ি তৈরি করান। তার নাম দেন শান্তিনিকেতন। ভিন্ন মতে প্রতাপ নারায়ণ কর্তৃক প্রদত্ত ওই জমির দলিলে উল্লেখ আছে শান্তিনিকেতন বাড়ি লাগোয়া ওই জমি মহর্ষিকে মৌরসি পাট্টা দেওয়া হয়। কিন্তু সেকালের সেই ছাতিম গাছ দু’টি আজ আর নেই। তার জায়গায় লাগানো দু’টি ছাতিম গাছের চারা মনে করিয়ে দেয় শান্তিনিকেতনের বুনিয়াদ রামমোহন রায়ের ধর্ম সাধনার উপর প্রতিষ্ঠিত। যাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে উপাসনা মন্দির।

                        ছাতিমতলায় বাঁধানো বেদি।

আনন্দ পাঠশালা থেকে পাঠভবন, বিশ্বভারতী থেকে শ্রীনিকেতন, কলাভবন থেকে সংগীতভবন–চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে কবিগুরুর কত সৃষ্টি। রোজই এখানে ভ্রমণার্থীর ভিড় লেগেই থাকে। এই ভিড় উপচে পড়ে পৌষ আর বসন্তোৎসবে। বিশ্বভারতী থেকে কিছুটা দূরে গড়ে উঠেছে পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতিকেন্দ্র। শান্তিনিকেতন ঘুরতে এসে অনায়াসেই তা দেখে নেওয়া যায়। কিন্তু সময়াভাবে আমাকে এ বারের মতো পর্যটন আবাসে ফিরতেই হল। তড়িঘড়ি তৈরি হয়ে নিলাম। চটজলদি খাওয়াদাওয়ার পাটও চুকিয়ে নিতে হল। চেক আউটের পর পর্যটন আবাস থেকে ফের টোটোতেই চাপতে হল। এ বার গন্তব্য বোলপুর স্টেশন। প্লাটফর্মে ট্রেন দাঁড়িয়ে ছিল। সংরক্ষিত কামরায় উঠে নির্দিষ্ট আসনে বসে পড়লাম। কিছুক্ষণ বাদেই ট্রেন ছেড়ে দিল। চলেছি বাড়ির দিকে। মনটা কিন্তু শান্তিনিকেতনেই পড়ে আছে।

আগে কয়েকবার শান্তিনিকেতন এসেছি। তবুও এখানে বারে বারে আসতে ইচ্ছে হয়। আসলে কালের গতিতে অনেক পরিবর্তনের পরেও কোপাইয়ের কাছে এলে এখনও পাওয়া যায় শালের ছায়াবীথি, বনপুলকের সুবাস। ভেসে আসে বাতাসে ঋতু বদলের গন্ধ। রবির আলোয় ফুটে ওঠে ইতিহাস। পাওয়া যায় ১৯ শতকের নবজাগরণের কিছু স্পর্শ।

ছবি : লেখক।

ভ্রমণের অভিজ্ঞতা যদি জানাতে চান, তা হলে লেখা ও ছবি পাঠান। ইউনিকোড বাঞ্ছনীয়। পিডিএফে পাঠাবেন না। ওযার্ড ফাইলে লিখুন ও পাঠান। ঠিকানা ও ফোন নম্বর দিতে ভুলবেন না। ই-মেল করুন– editor@thekolkataexpress.com  

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here