লিখছেন সফিউন্নিসা
গোটা পৃথিবী এক মারণ ভাইরাসের আতঙ্কে গৃহবন্দি। তাতে অবশ্য মৃত্যুমিছিল থামানো যায়নি। দু’লক্ষাধিক মানুষ মারা গিয়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ সংক্রমিত হয়েছে। আর কোটি কোটি মানুষ আতঙ্কের প্রহর গুনছে। লকডাউনের কবলে পড়ে শেষ হওয়ার পথে দেশের অর্থনীতি। পৃথিবীর তাবড় দেশগুলিতেও অর্থনৈতিক সংকট ঘনীভূত। এতো গেল আমাদের অস্তিত্বের সংকটের কথা। কিন্তু মানুষের জীবনের মূলভিত্তি যে পারিবারিক জীবন, সম্পর্কের বন্ধন, সেগুলি যে ভয়াবহ সংকটের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে, তার নির্মম ছবি এই করোনা আবহে নানা ঘটনায় একেবারে নগ্ন হয়ে ধরা পড়ছে ।
রোগটা নিঃসন্দেহে ভয়ংকর। এতে আতঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, মানুষ যুক্তিহীন হয়ে অমানবিক আচরণ করবে। কোনও এলাকায় কেউ করোনা আক্রান্ত হয়েছে জানতে পারলেই পাড়া-প্রতিবেশীরা যে ভাবে মারমুখী হয়ে উঠছে, তাতে মনে হয় যেন আক্রান্ত ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে রোগটি শরীরে বহন করে এনেছেন অন্যদের বিপন্ন করার জন্য। তাকে ধোপা-নাপিত বন্ধ করার মতো পরিবেশে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। প্রতিবেশীরা তাদের দেখলে দূরে সরে যাচ্ছে, মুদিখানা জিনিস বিক্রি বন্ধ করছে, তাদের বাড়িতে কেউ আসার চেষ্টা করলে তাদের ওপর হামলাও চলছে। মোটের ওপর আক্রান্ত বিপন্ন মানুষটি ও তার পরিবারকে হেনস্তার চরম পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
এই যুক্তিহীন, নিষ্ঠুর সামাজিক আচরণের ফলে সেই পরিবারটি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে, মানসিক দিক দিয়ে একাকীত্বের শিকার হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, পরিবারের কোনও সদস্য বাইরে থেকে এলে তাকে নিভৃতবাসের নামে একেবারে অচ্ছুৎ করে দেওয়া হচ্ছে। সুস্থতার সার্টিফিকেট দেখিয়েও বহুদূর থেকে অনেক কষ্ট করে ফেরা মানুষটিকে তার আপনজনরা দূর দূর করে তাড়িয়ে দেওয়ায় সে আত্মহত্যা করেছে, এমন একাধিক ঘটনাও ঘটেছে। বাবাকে ছেলে বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি, স্বামীকে স্ত্রী বাড়ি ফেরামাত্র মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে, করোনা ধরা পড়ার পর ছেলে মাকে জঙ্গলে ফেলে এসেছে, এ সব ঘটনা ক্রমাগত আমাদের চোখসহা হয়ে উঠছে। আর বিপদটা এখানেই। পরিবারের নিউক্লিয়াস স্তর থেকে বহির্বৃত্তের পরিধি যত বাড়ছে, মানুষের নিষ্ঠুরতার মাত্রা তত উগ্র হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে।
সামাজিক স্তরে এখন মানুষের হৃদয়হীনতা সবকিছুর মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এইরকম একটা ভয়াল পরিবেশে কী করে যে মানুষের মধ্যে নানা কুযুক্তি, নৃশংসতা, পৈশাচিক উল্লাস জেগে উঠছে, তা বোধগম্য হওয়া কঠিন। প্রথমত, কোনও বিশেষ সম্প্রদায় এই রোগের বাহক, এমন একটা রটনা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, যাতে ঘৃণার আগুন সহজে জ্বালানো যায়। বহু তথাকথিত মানুষও বেশ অন্ধের মতো তা বিশ্বাস করে তাদের সঙ্গে তাল মেলাচ্ছে। এমনকী অবলীলায় নানারকম বিদ্বেষমূলক মন্তব্যও তারা করছে । প্রাণঘাতী একটা রোগকে নিয়ে যে এমন অমানবিক আচরণ করতে পারে মানুষ, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল করোনা। শুধু তাই নয়, নিজে বাঁচব, অন্যেরা জাহান্নামে যাক–এই মানসিকতা ক্রমেই আমাদের জিনের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ যখন মাইলের পর মাইল অভুক্ত অবস্থায় রাস্তায় হাঁটছে, রাস্তাতেই মারা যাচ্ছে কী করুণভাবে, তাতে ক’জনের হৃদয় আলোড়িত হচ্ছে? সোশ্যাল মিডিয়ায় তখন আমজনতার একাংশ প্রায় প্রতিদিন নতুন নতুন রেসিপির ছবি পোস্ট করে ‘নয়া মনুষ্যত্বে’র স্বাক্ষর রাখছেন। একদল আবার ফেক নিউজ নিয়ে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের মন্তব্য বিতরণ করছেন।
করোনার আবহে যখন মানুষ মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার কথা, তখন দেখা যাচ্ছে একেবারে বিপরীত ছবি। মানুষের মধ্যে তীব্রগতিতে বাড়ছে অন্য অসহায় মানুষের প্রতি বিদ্বেষ আর সীমাহীন ঘৃণা, জিঘাংসা। শুধুমাত্র আমি বাঁচব। আমিই ভোগ করব সবকিছু–এ যেন সেই জঙ্গলের রাজত্বে ফিরে যাচ্ছে মানব সভ্যতা। প্রতিবেশীর প্রয়োজন নেই, ভিন্ন ধর্ম-সংস্কৃতির মানুষের অস্তিত্বই মুছে যাক, আমিই শুধু আমাকে নিয়েই বাঁচব।
এখানেই শেষ নয়, আমাদের অস্থি-মজ্জায় করোনা ঢুকিয়ে দিয়েছে সন্দেহের বীজ। আগামী সভ্যতার প্রতিটি মানুষ বহন করে চলবে এক একটি বিষবৃক্ষ। কোনও সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতে সে ভয় পাবে, তার মনে হবে সে বাদে আর সবাই বহন করছে মারণ ভাইরাস। বাইরের আমোদ-আহ্লাদে আসক্ত এই জাতির মনের গভীরে করোনার স্পাইক প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দেবে খাবারের প্লেটে, সুরার গ্লাসে ভাসছে অসংখ্য ভাইরাস। মুখের মাস্ক খুলতে ভয় পাবে সে, হাতে হাত মেলাতে পারবে না কারও সঙ্গে, হয়ত প্রেমও আর কাছে টানবে না ঈপ্সিতকে।
শেষ পর্যন্ত একমাত্র সত্য হবে মাস্ক, গ্লাভস, স্যানিটাইজার! একমাত্র সহজাত প্রবৃত্তি হবে ঈর্ষা, ঘৃণা, অসহিষ্ণুতা! মানুষ আর মানুষের মুখ দেখতে পাবে না, দেখবে শুধু মুখোশ! তা হলে মানুষের স্পর্শে মানুষ আর পাবেনা উষ্ণতা, সহৃদয়তা, পাবে ভয়। স্পর্শাতঙ্কে সবসময় তারা একের থেকে অন্যের দূরে থাকবে, আরও দূরে। দেখার শুধু নারী-পুরুষের জৈবিক সম্পর্ক আর মা-সন্তানের চিরন্তন সম্পর্কে কোনও মাত্রা যোগ হয় কিনা। হলে শেষের সেদিন হয়ে উঠবে ভয়ংকর।