গ্লোবাল মোদী লোকাল হতে চাইছেন

গ্লোবাল মোদী লোকাল হতে চাইছেন।  লিখছেন  প্রশান্ত ভট্টাচার্য


করোনা আবহে বিষয়টা নিয়ে তেমন করে আলোচনা হচ্ছে না। অথচ, নরেন্দ্র মোদী যে মঙ্গলবার জাতির উদ্দেশে এই লপ্তে পঞ্চমবার ভাষণ দিলেন, সেই দুপুরেই ভোটে কারচুপি ও অনিয়মের দায়ে গুজরাতে বিজেপি সরকারের মন্ত্রী ভূপেন্দ্র সিং ছুদাসামার নির্বাচন ও বিধায়ক পদ বাতিল করল গুজরাত হাইকোর্ট। এই ভূপেন্দ্র মোদী-শাহর বিশেষ ঘনিষ্ঠ এবং মুখ্যমন্ত্রী রূপানির দক্ষিণ হস্ত। ২০১৭ সালে গুজরাতে বিধানসভা নির্বাচনে এই প্রবীণ বিজেপি নেতার বিরুদ্ধে ভোট কারচুপি করে জেতার অভিযোগ উঠেছিল। হাইকোর্টে সেই অভিযোগ সত্য বলে প্রমাণিত হয়। কংগ্রেস নেতা অশ্বিন রাঠোরের পিটিশনের পরিপ্রেক্ষিতে মঙ্গলবার গুজরাত হাইকোর্টের বিচারপতি পরেশ উপাধ্যায় এই বিজেপি মন্ত্রীর নির্বাচন বাতিল ঘোষণা করেন। এই প্রসঙ্গ টেনে আনলাম এই কারণেই যে, আমাদের দেশের সংবাদমাধ্যমের একটা বড় অংশ বিজেপি সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা ফেরি করে। সুধীর-গোঁসাইদের কথা বাদই দিচ্ছি, আরও অনেক সংবাদমাধ্যমই মোদী-শাহর পাদুকা বহন করতে সদা প্রস্তুত। এ কারণেই প্রধানমন্ত্রীকে কেউ চ্যালেঞ্জও করেন না।

    আমি বলব, পৃথিবীর কিছু স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রনায়কদের সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতে দেখা যায় না, মোদী সেই গোষ্ঠীতেই পড়েন। কয়েকজন  নিয়ন্ত্রিত সাংবাদিককে বাদ দিয়ে সাধারণভাবে সব প্রেসের সামনে দাঁড়ানো মোদীজীর  পছন্দ নয়। উনি একলা কথা বলতে ভালবাসেন। তাই ভার্চুয়াল অ্যাপিয়ারেন্সে স্বমূর্তিতে থাকেন। করোনা আবহে এটি ছিল তাঁর পঞ্চম ভাষণ। চিত্রনাট্য অনুযায়ী ড্রামাটা খুব জমাতে পারেননি। তাই ভক্তরা বেজায় ব্যথিত। আর আত্মনির্ভর এবং আত্মনির্ভরতা। মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ৩৩ মিনিটের ভাষণে এই দুটো শব্দ উচ্চারিত হল ২৮ বার! ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতি এখন করোনা পজিটিভ উইথ সুগার অ্যান্ড কিডনি ঝামেলা হলে রোগীর যা হয়, সোজা ভেন্টিলেটরে গত দু’ মাসে আমাদের অর্থনীতির তাই হাল। সেই অর্থনীতিতে প্রাণ ফেরাতে মৃতসঞ্জীবনী ২০ লক্ষ কোটি টাকার আর্থিক প্যাকেজ। শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্ত, ছোট-মাঝারি শিল্পপতি, সবাই এই আর্থিক প্যাকেজ থেকে সুবিধে পাবেন। মোদী বলেন, দেশের অর্থমন্ত্রী এই প্যাকেজ বিস্তারিতভাবে ঘোষণা করবেন।

    শোনা গেল ভারত আবার ঘুরে দাঁড়াবে। করোনা মোকাবিলা করে একুশ  শতককে ভারতের শতাব্দী হিসেবে চিহ্নিত করার প্রতিজ্ঞার কথা শোনা গেল মোদীর গলায়। ব্যাপারটা হজম হল না। মানে এটা আবার কী ঢপ, ঠিক ঠাওর করতে পারলাম না। মোদী কয়েকবার বললেন, করোনার আগে আমাদের দেশে এক পিসও পিপিই তৈরি হত না। এখন নাকি প্রতিদিন দু’ লক্ষ করে পিপিই আরএন ৯৫ মাস্ক তৈরি হচ্ছে। আমরা নাকি, করোনার দয়ায় এই শিল্পে স্বয়ম্ভর হয়ে উঠছি। আমার মাথায় ঢুকল না, তবে কেন ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের উপযুক্ত বর্ম নেই বলে দেশের নানা জায়গায় বিক্ষোভ হচ্ছে? এমনকী, মোদী-শাহর সৌজন্যে ‘স্বর্গরাজ্য’ গুজরাতেও? ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র মন্ত্রে বিশ্বের মঞ্চে আর্থিক শক্তি হিসেবে প্রথম সারিতে উঠে আসার সংকল্পের কথাও বললেন নরেন্দ্র মোদী। কিন্তু সব কিছুই ঘুরপাক খেল এক বিন্দুতে, ‘আত্মনির্ভরতা’। কিন্তু এই ২০ লাখ কোটি টাকার জোগান কোথা থেকে হবে, সেটাই পরিষ্কার করে বলা হচ্ছে না। অথচ, ভাবতে অবাক লাগে, সরকারের পোষ্য সংবাদমাধ্যম ও ভক্তকুল যথারীতি অর্থনীতির তাত্ত্বিক অবস্থান ও তথ্যাদি শিকেয় তুলে আরও একটি ভাঁওতা দিতে উঠেপড়ে লেগেছে। বড় করে প্রচার করা হচ্ছে, মোদী সরকার ২০ লক্ষ কোটি টাকার আর্থিক প্যাকেজ তৈরি করেছে, যা ভারতের জিডিপির ১০%!

    বাচস্পতি মোদীর দাবি, করোনা এখন যত বড় বিপদ হিসেবে আসুক না কেন, তৈরি করুক না কেন যত বড় সংকট, দেশকে আত্মনির্ভর করার সংকল্প তার থেকেও মজবুত। আত্মনির্ভরতার জয়গান গেয়ে কখনও দেশে পিপিই কিট তৈরির কথা বলেছেন, কখনও তুলে এনেছেন ভূমিকম্পের পরে গুজরাতের কচ্ছের ফের খাড়া হওয়ার প্রসঙ্গ। সবরকম মোহিনী মুদ্রায় মোদী জানিয়ে দিলেন, আত্মনির্ভর ভারত দাঁড়িয়ে থাকবে পাঁচটি স্তম্ভের ওপরে- (১) সাহসী সংস্কার ও এক ধাক্কায় বড় পরিবর্তনে বিশ্বাসী অর্থনীতি (২) ভারতের পরিচিতি তৈরি করার মতো পরিকাঠামো (৩) এই শতাব্দীর উপযুক্ত, আধুনিক ও প্রযুক্তি নির্ভর প্রশাসন (৪) দেশের জনসংখ্যায় কম বয়সিদের প্রাধান্য (৫) চাহিদা: এক দিকে তাকে দ্রুত চাঙ্গা করার ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সঙ্গে তৈরি করতে হবে চাহিদা মেটানোর উপযুক্ত জোগান শৃঙ্খল। এ সব বেশ শুনতে ভাল লাগে, কিন্তু এতে কী আত্মনির্ভরশীল ভারত বানানো যাবে মোদীমশাই?

    যে পাঁচ স্তম্ভের কথা বলছেন, তার সব ক’টিই তো হাঁড়ির হাল! সাইনিং ইন্ডিয়ার অর্থনীতি টালমাটাল। স্বাস্থ্য পরিকাঠামো পাতে দেওয়ার নয়। পরিযায়ী শ্রমিকদের যা দশা, তাতে প্রশাসন প্রশ্নের মুখে। চড়া বেকারত্বের কারণে কমবয়সির সংখ্যা বেশি হওয়াটা আশীর্বাদ নয়, বরং অভিশাপ। আর সেই নোটবন্দির পর থেকেই সাধারণ মানুষের হাতে টাকা নেই, চাহিদা তলানিতে। আমার সহজ প্রশ্ন, নবরত্ন বেচে আম্বানি আর আদানির পকেট ভরিয়ে দেশের অর্থনীতির হাতে ক্র্যাচ ধরিয়ে এখন ‘আত্মনির্ভর ভারত!’ আচ্ছা, এত আত্মনির্ভরতার কথা কাদের খুশি করতে মোদীবাবু? নাগপুর কি কিছু নির্দেশ দিয়েছে? আমার মনে হয়, প্রধানমন্ত্রীর এ দিনের বক্তৃতা সম্ভবত সব থেকে বেশি আমোদিত সঙ্ঘ। বিশেষ করে আত্মনির্ভর হওয়ার জন্য মোদীর দাওয়াই দেশি জিনিস কেনার, দেশি জিনিস ব্যবহারের। আর এই বাণী মধুর হয়ে বাজছে বিশেষ করে সঙ্ঘ পরিবারের সদস্য স্বদেশি জাগরণ মঞ্চের কানে। সেই ২০১৪ সাল, মোদী ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই স্বদেশি পণ্যর বাজার তৈরির দাবিই জানিয়ে এসেছে জাগরণ মঞ্চ। করোনা-সংকটের ফেরে পড়া মোদী সরকার এই পরিকল্পনা রূপায়ণের সুবর্ণ সুযোগ হাতের নাগালে পেয়ে গিয়েছে। গ্লোবাল মোদী লোকাল হতে চাইছেন। যদিও আজকের এই বিশ্বায়িত অর্থনীতির জমানায় তা কতটা সম্ভব, সে বিষয়ে সন্দেহ যথেষ্ট। তবে মোদীর অন্যতম শাহরেদ ও আরএসএস সেবক অমিত শাহ বুধবার দিনই দেশের সবক’টি আধা সামরিক বাহিনীর ক্যান্টিনে স্বদেশি পণ্য রাখার নির্দেশ দিয়ে দিয়েছেন। আগামী ১ জুন থেকে দেশের আধা সামরিক বাহিনীর কোনও ক্যান্টিনে স্বদেশি ছাড়া কোনও পণ্য রাখা যাবে না। মোদীর ঘোষণা আর শাহর হুকুম সঙ্ঘ, স্বদেশি জাগরণ মঞ্চের মানসিকতার প্রত্যক্ষ প্রতিফলন। নাগপুর বরাবরই চায় দেশীয় পণ্য তৈরিতে জোর দিতে।

    বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নাগপুরের চাপের মুখেই শেষ মুহূর্তে ১৬ দেশের প্রস্তাবিত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (আরসিইপি) থেকে সরে এসেছিল নয়াদিল্লি। দেশীয় উপায়ে চাষ থেকে দেশেই সমস্ত পণ্য তৈরির জন্য ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ সব কিছুতেই সরব তারা। সেবক প্রধানমন্ত্রী মোদীরও এ দিন পরামর্শ, দেশের মানুষ দেশে তৈরি জিনিস কেনার পাশাপাশি তার জয়গান করুক। তা হলেই নাকি তা ধীরে ধীরে ব্র্যান্ড হয়ে উঠবে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড। কিন্তু প্রশ্ন, এ দেশের মানুষ যদি শুধু ভারতে তৈরি পণ্য কেনারই পণ করেন, তা হলে অন্য দেশই বা ভারতের পণ্য কিনবে কেন? যে দেশের অজস্র মানুষ অনাবাসী, তাদের পক্ষে এই ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব কি? তাদের এই স্বদেশি পণ্য নিয়ে লম্ফঝম্প কি আরেকটা মুখোশ নয়? আর স্বদেশ কোনওদিনই তার মানুষকে বাদ দিয়ে নয়, যে সরকার দেশের সব মানুষকে সমান নজরে দেখতে জানে না, শ্রমজীবীদের দেখে বোঝা হিসেবে আর বিদেশে বসবাসকারীদের রাজহাঁস হিসেবে, বিধর্মীদের দেখে সন্ত্রাসবাদী হিসেবে আর স্বধর্মীদের দেখে সোনার ছেলে হিসেবে, সেই সরকারের স্বদেশিপনা আরেকটি বড় রকমের ধাপ্পা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here