ফের পেঙ্গুইনের দেশে পা যাদবপুরের প্রাক্তনীর

অনিমেষ বসু সরকার

লড়াইটা যে খুবই কঠিন, তা জেনেও পিছিয়ে নেই ভারতীয় মেয়েরা। ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাঁরাও বিশ্বের সবচেয়ে শীতল ও শুষ্ক মহাদেশ অ্যান্টার্কটিকায় পা রাখছেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই আবার বাঙালি। ১৯৮৩ সালে শুধু বাঙালি হিসাবে নয়, প্রথম ভারতীয় মহিলা যিনি অ্যান্টার্কটিকায় পা রেখেছিলেন, তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূবিদ্যা বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপিকা ড. সুদীপ্তা সেনগুপ্ত। এ বার তাঁরই ছাত্রী ড. নীলাঞ্জনা সরকার সেখানে পা রাখলেন।

ছবি-১

     যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রাক্তনী বছর পঁয়ত্রিশের নীলাঞ্জনা এখন কেরালার তিরুবনন্তপুরমে ভারত সরকারের ভূ-বিজ্ঞান মন্ত্রকের অধীন ন্যাশনাল সেন্টার ফর আর্থ সায়েন্স স্টাডিজের (এনসিইএসএস) বিজ্ঞানী। তিনি গবেষণার জন্য অ্যান্টার্কটিকার ৩৯ তম ভারতীয় বৈজ্ঞানিক অভিযানে অংশ নিয়েছেন। সেইমতো তিনি গত ১৩ ডিসেম্বর সেখানে পা রাখেন। দিনটি ছিল নীলাঞ্জনার স্বপ্নপূরণের দিন।

ছবি-২

    জাতীয় মেরু ও সামুদ্রিক গবেষণা কেন্দ্রের (এনসিপিওআর) এক অধিকর্তা ড. রাহুল মোহন জানান, ‘‘গত ৩৭ বছরে গবেষণার কাজে মোট ১৩৯৩ জন ভারতীয় বিজ্ঞানী অ্যান্টার্কটিকায় গিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে যে ৬৫ জন মহিলা অংশ নিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে সুদীপ্তা সেনগুপ্ত ছাড়া রয়েছেন আরও ৭ জন বাঙালি। তাঁরা হলেন, মীনাক্ষী চট্টোপাধ্যায়, ৱুলগানিন মিত্র, দীপিকা রায়, রূপালি পাল, সুদীপ্তা শাসমল,  গৌতমী সামুই ও অরিত্রি সান্যাল। এ বারে ৩৯ তম অভিযানেও মহিলারা ছিলেন। তাঁদের মধ্যে নীলাঞ্জনা ছাড়া ছিলেন চেরিল জি মেলো, মিচেল ফার্নান্ডেজ, শিপ্রা সিনহা ও সারদা সুন্দরা মূর্তি। এই ৫ জনের মধ্যে একমাত্র বাঙালি নীলাঞ্জনা।’’ তাই বলতেই হয় দরজাটা খুলে দিয়েছেন সুদীপ্তা সেনগুপ্ত। তাঁরই দেখানো পথে ছেলেদের সঙ্গে মেয়েরাও দক্ষিণ মেরুতে পা রাখছেন।

ছবি-৩

    ১৯৮৩ সালের পর ২০১৯। নীলাঞ্জনার অভিযান তাঁর স্বপ্নপূরণের অভিযান। জানাচেছন সুদীপ্তা সেনগুপ্ত। নীলাঞ্জনাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘যাদবপুরে ভূবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনার সময় নীলাঞ্জনা আমাকে দেখে অ্যান্টার্কটিকা যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল। এমনকী বলেও ছিল আমার কথা জেনেই ও ভূবিদ্যা নিয়ে যাদবপুরে পড়তে এসেছে।’’ পেঙ্গুইনের দেশে কী নিয়ে গবেষণা করছেন নীলাঞ্জনা? সূত্র বলছে, বরফের চাদরে মোড়া পূর্ব অ্যান্টার্কটিকার সঙ্গে ভারতের পূর্বঘাট অঞ্চল একে অপরের সঙ্গে সংলগ্ন ছিল। প্রোটেরোজিক যুগে কোনও এক সমযে দু’টি ভূখণ্ড টেকটোনিক কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এই দু’টি ভূখণ্ডের পারস্পরিক সম্পর্ক বোঝার পাশাপাশি ভূতাত্ত্বিক কাঠামোর বিশ্লেষণ ও তার তাপপ্রবাহ নির্ধারণের মধ্যে দিয়ে বিবর্তন সম্পর্কে ধারণা করাই নীলাঞ্জনার গবেষণার লক্ষ্য।

ছবি-৪

   এই কাজের জন্য অ্যান্টার্কটিকায় তাঁর সফরসঙ্গী হয়েছিলেন ড. কুমার বাটুক যোশী ও ড. পদ্মা রাও বোমমুজু। তাঁরাও এনসিইএসএসের বিজ্ঞানী। সংস্থাটি থেকে এই প্রথম তিন বিজ্ঞানী পেঙ্গুইনের দেশে পা রাখলেন। ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর তিরুবনন্তপুরম থেকে প্রথমে তাঁরা গোয়ায় যান। সেখান থেকে বিমানে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউন ছুঁয়ে তাঁরা অ্যান্টার্কটিকায় পা রাখেন। তিন বছরের প্রকল্প হলেও প্রথম ধাপে গত  জানুয়ারি মাস পর্যন্ত পূর্ব অ্যান্টার্কটিকার লার্সম্যান পাহাড়ের পিছনে ভারতের তৃতীয় গবেষণা কেন্দ্র ‘ভারতী’ ছিল তাঁদের ঠিকানা। যদিও অ্যান্টার্কটিকায় পা রেখে প্রথম কয়েকদিন তাঁদের ভারতের দ্বিতীয় গবেষণা কেন্দ্র ‘মৈত্রী’তে থাকতে হয়েছে। এখানে ভারতের প্রথম গবেষণা কেন্দ্র ‘দক্ষিণ গঙ্গোত্রী’ বরফের নীচে চাপা পড়ে আছে। ‘মৈত্রী’ থেকে বিমানে চেপে তাঁদের পৌঁছোতে হয় সাড়ে তিন হাজার কিমি দূরে ‘ভারতী’ গবেষণা কেন্দ্রে।

ছবি-৫

    এই সফরের যাবতীয় খরচ বহন করে ভূ-বিজ্ঞান মন্ত্রক। দলটিতে ‘প্রজেক্ট ইনভেস্টিগেটর’ (পিআই) হয়ে কাজের দায়িত্ব পালন করেন নীলাঞ্জনা। এই দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে তাঁদের শারীরিক সক্ষমতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়েছে। এনসিপিওআর জানাচ্ছে, সেইমতো প্রথমে তাঁদের দিল্লির এইমসে ডাক্তারি পরীক্ষার পর আউলি, বদ্রিনাথ, চরণপাদুকা ও বসুধারায় গিযে আইটিবিপি’র কাছ থেকে শিখতে হয়েছে পাহাড়ে ওঠানামা থেকে বরফের ওপর চলাফেরা, বিপরীত পরিস্থিতিতে আত্মরক্ষা এবং দলকে বাঁচানোর কৌশল। কারণ, দক্ষিণ মেরুতে গবেষণার কাজ করতে গিয়ে যে কোনও সময়ে প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হতে পারে। সেই পরিস্থিতি সামাল দেওয়াটা রীতিমতোই চ্যালেঞ্জ। মানছেন কলকাতার আঞ্চলিক আবহাওয়া কেন্দ্রের আবহবিদ দেবদীপ চক্রবর্তী। তিনিও ৩৯ তম অ্যান্টার্কটিকা অভিযানে দলনেতাদের মধ্যে একজন। তবে সফর নিয়ে ঘরের মেয়েকে কাছে পেয়ে সুদীপ্তা সেনগুপ্তের বার্তা, ‘‘স্বপ্নপূরণ হল আসলে মানসিক প্রস্তুতি। সফল হতে গেলে লড়াই করতেই হয়।’ অ্যান্টার্কটিকায় পা রেখে সেই লড়াইটাই করতে হয়েছে নীলাঞ্জনাকে।

 ছবি- ফেসবুক থেকে সংগৃহীত ।

ছবি-

১) মাঝে সুদীপ্তা সেনগুপ্ত। তাঁর বাঁ পাশে নীলাঞ্জনা সরকার, ডানে দেবদীপ চক্রবর্তী।

২) পেঙ্গুইনের দেশে পা রাখার পর আত্মহারা নীলাঞ্জনা।

৩) অ্যান্টার্কটিকায় ভারতের গবেষণা কেন্দ্র ‘ভারতী’।

৪) বরফের দেশে পাথরের খোঁজে নীলাঞ্জনা।

৫) এই গাড়িতে চেপে পাথর কাটতে যাওয়ার আগে নীলাঞ্জনা।

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here