জানাচ্ছেন বন্ধ্যাত্ব ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ ইন্দ্রনীল সাহা
ইনফার্টিলিটি বা বন্ধ্যাত্ব যতক্ষণ না কেউ নিজে এই সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত এ নিয়ে কারওরই মাথাব্যথা থাকে না। সবাই ধরে নেন সন্তান সন্তানধারণ খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। চাইলেই কেউ মা কিংবা বাবা হতে পারেন। কিন্তু বিয়ের পর যখন এই চাহিদা পূরণ হয় না, তখন স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা ভেঙে পড়েন।
ইনফার্টিলিটি বা বন্ধ্যাত্ব কী?
বিবাহিত জীবনে বছরখানেক কোনও গর্ভনিরোধক ব্যবস্থা না নিয়ে স্বাভাবিক যৌন জীবনযাপন করার পরেও যদি কেউ সন্তানধারণ করতে না পারেন, তা হলে ধরা হয় বন্ধ্যাত্বে সমস্যা আছে। আর ৩৫-এর বেশি বয়সি কোনও মহিলার ক্ষেত্রে এই সময়সীমা ধরা হয ৬ মাস। যদিও এখন সবাই জানেন বন্ধ্যাত্বের জন্য নারী-পুরুষ যে কেউই দায়ী হতে পারে।
কারণ কী?
মহিলাদের জননাঙ্গের গঠনগত ত্রুটি, জরায়ুতে পলিপ বা ফাইব্রয়েড থাকলে, ফ্যালোপিয়ান টিউবের ব্লকেজ, এন্ডোমেট্রিওসিস এবং পুরুষদের স্পার্মের অনুপস্থিতি-সহ একাধিক কারণে বন্ধ্যাত্ব দেখা দিতে পারে। তবে উপযুক্ত চিকিসা বন্ধ্যত্বের সমস্যা দূরে সরিয়ে অনেকেই সন্তানের মুখ দেখতে সক্ষম হয়েছেন এবং হচ্ছেন।
সমস্যা যখন নারীর
এক আধটা নয, সন্তান না হওয়ার জন্য মহিলাদের একগুচ্ছ সমস্যা দায়ী। যেমন, পলিসিস্টিক ওভারিযান সিনড্রোম বা পিসিওএস, যা বন্ধ্যাত্বের জন্য অনেকাংশে দায়ী। উপসর্গ হিসাবে ওজন বেড়ে যাওয়া, ঘনঘন মুড বদলানো, মুখে রোমের আধিক্য, ব্রণ ও পিরিয়ড অনিয়মিত হতে পারে বা ওভ্যুলেশন ঠিকমতো না হওয়া। পিসিওএস নির্ণয় করার জন্য কখনও পেটের আল্ট্রাসোনোগ্রাফি বা দরকারে রক্ত পরীক্ষা করা হয়। ওষুধের পাশাপাশি ওজন কমানোর দিকে জোর দেওয়া দরকার| এ ছাড়া ফল-সবজি বেশি করে খাওয়া, ফাস্টফুড এড়িয়ে চলা, প্রতিদিন খানিকক্ষণ করে হাঁটতে পারা সমস্যার সমাধানে সাহায্য করে।
ফ্যালোপিয়ান টিউবের ব্লকেজ বিশেষ ধরনের সংক্রমণ, এন্ডোমেট্রিওসিস কিংবা গঠনগত ত্রুটির জন্য হতে পারে। এই টিউব বন্ধ থাকলে শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মিলন সম্ভব হয় না। ওষুধ, ছোটখাট অপারেশনেই অনেক সময় এই ত্রুটি দূর করা সম্ভব হয়। একান্তই যদি সমস্যার সমাধান না হয়, তা হলে টেস্টটিউব বেবির চিন্তাভাবনা করতে হয়।
জরায়ুর ফাইব্রয়েড কী?
সহজভাবে বলা যায, জরায়ুর মধ্যে থাকা এক বা একাধিক টিউমার। বেশিরভাগ সময়ে এগুলোর কোনও উপসর্গ থাকে না। তবে কখনও কখনও আপাত নিরীহ এই টিউমার সমস্যা তৈরি করতে পারে। তখন অতিরিক্ত বা অনিয়মিত ঋতুস্রাব, প্রচণ্ড পেট ব্যথা, সাদা স্রাব ও বন্ধ্যাত্ব দেখা দিতে পারে।
এন্ডোমেট্রিওসিস কী?
জরায়ুর ভেতরের দিকে যে লাইনিং বা দেওযাল থাকে, তাকে বলে এন্ডেমেট্রিয়াম। এই এন্ডেমেট্রিয়াম টিস্যু বাইরে বেরিয়ে এলে তাকে বলা হয় এন্ডোমেট্রিওসিস। যা জরাযু ছাড়াও থাকতে পারে ফ্যালোপিয়ান টিউবে, এমনকী ওভারিতে। এর লক্ষণ হল অতিরিক্ত ঋতুস্রাব, সঙ্গে প্রচণ্ড পেট ব্যথা। ল্যাপারোস্কোপির সাহায্যে এই রোগ নির্ণয় করা যায়। জন্মনিরোধক বড়ি, ইন্ট্রা ইউটেরাইন ডিভাইস কিংবা অপারেশন, যার যে পদ্ধতি উপযুক্ত, সেই পদ্ধতির মাধ্যমেই চিকিসা করা হয়।
উভয়ের সমস্যা
সেক্সুয়ালি ট্রান্সমিটেড ডিজিজের সমস্যা স্বামী ও স্ত্রী’র দু’জনেরই হতে পারে। একজনের থেকে অন্যজনে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে সমস্যা বাড়ে। সংক্রমণ থেকে ফ্যালোপিয়ান টিউবে কিংবা জরায়ুতে ক্ষত হতে পারে। দেখা দিতে পারে একটোপিক প্রেগন্যান্সির মতো সমস্যা। এ ধরনের ইনফেকশন সারাতে অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিফাংগাল বা অ্যান্টিভাইরাল জাতীয ওষুধ দিয়ে চিকিত্সা করতে হয়।
অতিরিক্ত ওজন
সন্তানধারনের পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে মাত্রাতিরিক্ত ওজন। নারী কিংবা পুরুষ যে কারওর স্থূলতা ডেকে আনতে পারে বন্ধ্যাত্ব। কাজেই ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। উচ্চতার সঙ্গে ওজন মানানসই না হলেই বিপদ। আবার বেশি রোগা হলেও সমস্যা হতে পারে।
মানসিক চাপ, ধূমপান ও মদ্যপান
বীর্যহীনতার কারণ প্রচণ্ড মানসিক চাপ, কাজের চাপ, দুশ্চিন্তা, অনিদ্রা, ধূমপান ও মদ্যপান। তেমনই মহিলাদেরও এই সব কারণে বন্ধ্যাত্ব দেখা দিতে পারে।
দায় পুরুষেরও
সমীক্ষা বলছে, ভারতের শহরগুলোতে প্রতি ৫ জনে একজন পুরুষ বীর্যহীনতার সমস্যায় ভুগছে। যার ফল বন্ধ্যাত্ব। যেমন, মাম্পস। বয়ঃসন্ধির সময় বা পরে মাম্পস হলে পুরুষের অণ্ডকোষে শুক্রাণু উপাদনকারী কোষ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ফলে কোনও পুরুষ আজীবন বীর্যহীনতায় ভুগতে পারে। আর ভ্যারাইকোসেল হল অণ্ডথলিতে শিরাঘটিত সমস্যা। ঠিকমতো রক্ত চলাচল করতে পারে না বলে অণ্ডকোষে শুক্রাণুও কম তৈরি হয়। আবার অস্ত্রোপচার বা ক্ষত থেকেও সমস্যা তৈরি হয়। কারণ, কোনওভাবে অণ্ডকোষে গুরুতর আঘাত লাগলে বা কোনও ক্ষত তৈরি হলে শুক্রাণু তৈরিতে প্রভাব পড়ে। একই সমস্যা তৈরি হতে পারে হার্নিয়া হলেও। আবার যে সব ব্যক্তি খুব গরম পরিবেশে অনেকদিন ধরে কাজ করে, তাদেরও শুক্রাণুর পরিমাণ কমে যায়।
শুক্রাণু বা স্পার্মের সমস্যা
পুরুষদের শুক্রাণুর নানান সমস্যা থাকতে পারে। কারওর একেবারেই শুক্রাণু না থাকতে পারে (অ্যাজুস্পারমিয়া), কারওর কম থাকতে পারে (অলিগোস্পারমিয়া), কারওর আবার শুক্রাণুর চলাচলে ত্রুটি থাকতে পারে (অ্যাস্থেনোস্পারমিয়া), কিংবা শুক্রাণুর গঠনগত ত্রুটি (টেরাটোস্পারমিয়া) থাকা অস্বাভাবিক নয়। এ ছাড়াও কোনও সংক্রমণ থাকলেও সমস্যা দেখা দিতে পারে। তবে কারণ যাই হোক না কেন, ঠিক সময়ে যদি উপযুক্ত চিকিসা শুরু করা যায়, তা হলে যে কোনও সমস্যারই সমাধান সম্ভব।