একবিংশ শতকের নারী কোন পথে চলেছে, লিখছেন সফিউন্নিসা ।
(পর্ব-৪)
উলটপুরাণ
মহারাষ্ট্রের অমরাবতীতে একটি গার্লস কলেজে তথাকথিত ভ্যালেনটাইন ডে’র আগের দিন মেয়েদের দিয়ে শপথ নেওয়ানো হয়েছে, আমি ঘোষণা করছি, বাবা-মায়ের প্রতি আমার পূর্ণ আস্থা আছে। চারপাশে যা ঘটছে, ‘সেই প্রেক্ষিতে আমি বলতে চাই, কখনও প্রেমের জালে জড়িয়ে পড়ব না। প্রেম করে বিয়েও করব না।’
এ বার চোখ ফেরানো যাক গুজরাতে। একদিনের ব্যবধানে ঘটা ঘটনা। ভুজ শহরের শ্রীসহজানন্দ গার্লস কলেজে ৬৮জন ছাত্রীকে শৌচাগারে নিয়ে গিয়ে তাদের পোশাক খুলতে বাধ্য করেছেন এক শিক্ষিকা। কারণ, তাদের মধ্যে ঋতুমতী কতজন, তা ক্লাশ চলাকালীন তিনি জানতে চাইলে মাত্র দু’জন ছাত্রী স্বীকার করলে বিষয়টি অবিশ্বাস্য মনে হয় ওই শিক্ষিকার। তাই হাতে গরম প্রমাণ পেতে তিনি এই কাজ করেছেন। আর এর মধ্যে কোনও অন্যায় তিনি দেখতে পাননি। হঠাৎ এ হেন তৎপরতা কেন ? সূত্র বলছে, মেয়েরা কলেজ সংলগ্ন যে হস্টেলে থাকে, সেখানে তারা নাকি কোনও ধর্মীয় আচার আচরণ মানে না। হস্টেল কর্তৃপক্ষ কলেজের ডিন দর্শনা ঢোলকিয়ার কাছে অভিযোগ করেছে, ঋতুমতী অবস্থায় নাকি কেউ কেউ নিজেদের আলাদা না রেখে সহপাঠীদের সঙ্গে মেলামেশা করছে, রান্নাঘরেও ঢুকছে। তার চেয়েও গুরুতর ‘অপরাধ’ যে, কিছু সংখ্যক মেয়ে নাকি কলেজ চত্বরের মন্দিরেও প্রবেশ করছে। সে দিনই এক শিক্ষিকা অতি তৎপর হয়ে ক্লাশের সব মেয়ের ‘পবিত্রতা’র পরীক্ষা নিয়েছেন দায়িত্বশীল ‘মানুষ’ হিসাবে। জাতীয় মহিলা কমিশন অবশ্য এই ঘটনায় অসন্তোষ প্রকাশ করে তদন্তে নামার সিদ্ধান্ত নেয়।
স্বাভাবিক ভাবেই একবিংশ শতকের নারী কোন পথে চলেছে, এই প্রশ্ন উঠছে। কারণ, তারাই তো বলছে, আমরা বিচার চাই। প্রেক্ষিতটা হল, একদিকে কলেজে পড়া মেয়েদের সমবেতভাবে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নেওয়া হচ্ছে, তারা কোনওদিন প্রেম করবে না। অর্থাৎ তারা সামাজিক কিছু প্রাগৈতিহাসিক নিদান মেনে চলবে। এমনটাই এখনও চান সমাজের জ্যাঠামশাইরা। মেয়েদের নিজস্ব পছন্দ অপছন্দ থাকবে না, তারা মস্তিষ্কবর্জিত একটা ছাঁচে ফেলা পুতুল ছাড়া আর কিছু নয়। পুরুষের সমাজ তাদের যে ভাবে দেখতে চায়, ঠিক সেইভাবেই তারা থাকবে, বাঁচবে। না হলে এই তো সবে শৌচাগারের প্রাথমিক পরীক্ষা। এরপর যা যা হবে, তা অনুমান করা যেতেই পারে। দু’দিনের মধ্যেই তো এক সমাজকর্তা ঘোষণা করেছেন মেয়েরা লেখাপড়া শেখার ফলে ডিভোর্সের সংখ্যা বাড়ছে। অর্থাৎ লেখাপড়া না শেখানো হলে সংসার দিব্যি সোনার সংসার হবে।
ব্রেনলেস জন্তু এমনিতে প্রকৃতি সৃষ্টি করেনি। পুরুষ মানুষই একমাত্র পেরেছে মেয়ে মানুষকে নানা জুজুর ভয় দেখিয়ে তার মগজকে একেবারে কব্জা করে ফেলতে। সংস্কারের ভূত যুগ যুগ ধরে তাদের মাথায় এমনভাবে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, যে তারা নিজেদের বিষয়ে কিছু ভাবতেই শেখেনি। আর এটাকেই ‘নারীত্ব’ বলে গৌরবান্বিত করা হয়েছে তাদের। সতীনারী সবসময় পতির অনুগামিনী। কিন্তু সময়ের অনিবার্য নিয়মে মেয়েরা বৈধব্যের ভয় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বইখাতা হাতে নিয়েছে বহুকাল হ’ল। এখন তারা আপন যোগ্যতায় সাফল্যের শিখরে নিজেদের নিয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, তারা প্রশ্ন করতে শিখেছে শুধু নয়, তারা যে কোনও বিষয়ে চ্যালেঞ্জ করতে পিছপা হচ্ছে না। মেয়েদের এতটা আত্মপ্রকাশ মেনে কি নেওয়া যায় সহজে? তাই পুরনো ‘সুখের’ দিনগুলিকে ফিরিয়ে আনার জন্য কতরকম ক্রিয়াকৌশল যে আরও বেরিয়ে আসবে, তা বলাই বাহুল্য।
ভেবে দেখার, বিগত কয়েক দশক আগেও মেয়েদের অবস্থা যা ছিল, এখন কিন্তু তার চাইতে অনেক শোচনীয় হয়ে উঠেছে। শিক্ষা, কর্মদক্ষতায় তারা যত এগিয়ে চলেছে, সমাজের গভীর থেকে যেন ততই অসন্তোষের বাষ্প ঘনীভূত হচ্ছে। মেয়েদের প্রতি ন্যূনতম সৌজন্যবোধ আর দেখানোর দায় বোধ করে না অধিকাংশ পুরুষ। প্রকাশ্য রাস্তায় যত্রতত্র অশালীন আচরণ, এমনকী বাস, ট্রেন, মেট্রোর মতো জনবহুল জায়গাতে চরম অশ্লীলতা দেখানোতেও অকুতোভয় অনেকেই। মেয়েদের যৌনদাসী ভাবার অভ্যাস অনেক পুরুষের মজ্জাগত হওয়ায় তারা বুঝতেও পারে না, তাদের অপরাধের গুরুত্বটা।
সম্প্রতি কয়েকজন সমাজকর্মী জেলবন্দি কয়েকজন ধর্ষকের ওপর সমীক্ষা করতে নেমে হতবাক হয়ে গিয়েছেন। প্রায় প্রত্যেকেই অম্লানবদনে জানিয়েছে, তারা যা করেছে, তা অন্যায় বলে তারা কেউ ভাবে না। বরং তারা মেয়েদের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছে, কেন তারা অনেক রাতে বাইরে বের হয়? কেন তারা উলটো-পালটা পোশাক পরে? আরও অদ্ভুত যুক্তি, ভালো মেয়েরা কখনও এ সব করে না। অর্থাৎ তাদের মূল্যায়নের মাপকাঠিতে যে মেয়েকে যথাযথ না মনে হয়, তারা খারাপ। আর খারাপ মেয়ে মানেই তার সঙ্গে যা ইচ্ছা করা যায়। এই রকম মানসিকতা যে শুধুমাত্র দাগি আসামিদের মধ্যে দেখা যায়, ব্যাপারটা মোটেই তেমন নয়। আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অনেক তথাকথিত ভদ্রলোকরাও প্রায় একই মানসিকতা বহন করে চলেছেন।