সমাজ নাকি উল্কার বেগে এগিয়ে চলেছে। ভাবতে তো ভালোই লাগে। কিন্তু বাস্তবে কী দেখা যাচ্ছে? লিখছেন সফিউন্নিসা।
(পর্ব-৩)
মেয়েদের প্রগতি
সেনাবাহিনীর উচ্চপদে মহিলাদের নিয়োগে আপত্তি। কারণ, পুরুষ সহকর্মীরা মেনে নিতে বাধ্য হলেও উঁচু পদে আসীন যে সব অফিসার, তাঁরা মহিলাদের ‘বস’ হিসাবে মেনে নিতে পারবেন না। অথচ, এই মেয়েরাই চাঁদে গিয়েছেন, মহাকাশেও পাড়ি দিয়েছেন। সুনীতা উইলিয়াম নারীজগতের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। কল্পনা চাওলা তো বহুধা হয়ে অনন্তকাল ধরে মহাশূন্যে তীব্রবেগে ঘুরে চলার নিয়তিকে বরণ করে নিয়েছেন। এরপরেও মহিলাদের সম্পর্কে পুরুষতন্ত্রের কী মানসিকতা!
সাধারণ কর্মজগতেও এই একই ছবি। অথচ, চারের দশক থেকেই জীবিকার তাগিদে মেয়েরা পথে নেমেছেন। ঝোড়ো রাজনৈতিক আবহে, দেশভাগের তীব্র অভিঘাতে মানুষের জীবন তখন হালভাঙা দিশাহীন নৌকার মতো। অস্তিত্বরক্ষার তাগিদে নারী-পুরুষ সেদিন পথে নেমেছিল একসঙ্গে। আর আটটি দশক পেরিয়ে সামাজিক সব বাধার বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে মেয়েরা প্রতিমুহূর্তে নিজেদের প্রমাণ করতে করতে এগিয়ে চললেও এখনও কী বিদ্বেষ পোষণ করে চলেছে পুরুষতন্ত্র।
প্রতিটি কাজের জায়গায় অধিকাংশ পুরুষ সহকর্মী মেয়েদের অনধিকার প্রবেশকারী হিসাবে দেখে। তাঁরা মনে করেন, তাঁদের জগতে ঢুকে মেয়েরা তাঁদের প্রাপ্যতে ভাগ বসাচ্ছে। অনেক সহকর্মীই মনে করে মেয়েদের উপার্জন তাদের শখ আহ্লাদ মেটাতেই তাঁরা ব্যয় করেন। সংসারের বিশেষ কাজে লাগে না তা। তাই কর্মক্ষেত্রে তাঁরা এক ধরনের ঈর্ষা বহন করে চলে। অনেককেই বলতে শোনা যায়, মেয়েরা অনেক বেশি সুযোগ নেয়। তাদের প্রধানতম অভিযোগ, মেয়েরা দীর্ঘদিন মেটারনিটি লিভ ভোগ করে। তারা কাউকে এতটুকু জমি ছাড়তে রাজি নয়। অথচ আইন তা দিয়েছে বলেই তাদের ক্ষোভ আর প্রশমিত হয় না। এটাকে তারা মেয়েদের প্রাপ্য অধিকার বা আইনি ন্যায্য পাওনা বলে মানতে পারে না। ফলে কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, নয় তো চরম অসহযোগিতা তারা সমবেতভাবেই করে চলে।
বলতে লজ্জা করে পাকিস্তানের মতো দরিদ্র, মৌলবাদী দেশেও কয়েকবছর আগেই সেনা বাহিনী উঁচুপদে মেয়েদের বসানো হয়েছে। শুধু তাই নয়, তাঁরা যোগ্যতা ও দক্ষতার সঙ্গে তাঁদের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। আর জ্ঞানে গরিমায় সেই প্রাচীন যুগ থেকেই মেয়েরা যে দেশে চরম উৎকর্ষতার চিহ্ণ রেখে আসছে, তাদের জন্য এই পুরস্কার কি প্রাপ্য ছিল?
গড় পুরুষ মানসিকতায় নারী হল, সংসারের জোয়াল টানা দ্বিপদ বিশিষ্ট সর্বংসহা জীব বিশেষ। এ কালের এক সোস্যাল মিডিয়াখ্যাত কবি লিখেছেন, ‘নারী, তুমি সৈনিক হতে পারো, অধ্যক্ষ নও / পরিবার কাঁধে আর সন্ততি কোলে কাঁখে বও,/ ওখানেই থামো। মেনে নাও ওটাই নিয়তি, / পুরুষ মানবে না নাকি নারী হলে সেনাপতি। / রাষ্ট্র এমনই বলে আদালতে মহাসোচ্চারে,/ বুঝে নাও দেশে কেন দিকে দিকে ধর্ষণ বাড়ে, / নারী ভোগ্য শুধু, যোগ্য নয় দেশের সীমান্তে / আজগুবি আরও কত কপালে রয়েছে বাকি জানতে। / এটা সেই দেশ, যেখানে শাস্ত্রে লেখা রয়েছে কাহিনি / দেবতারা ভয় পেলে অসুর মারেন একা সিংহবাহিনী।’
সব কিছু সাফল্যের মূলে এমনই এক প্রাগৈতিহাসিক ধারণা রক্তে মজ্জায় বহন করে চলেছে আজকের বহু পুরুষ। আর তাদের যাবতীয় কৃতকর্মের অবাঞ্ছিত দায় নারীর, সে ধর্ষণই হোক বা অন্যকিছু। তা না হলে, যখন নারীর ওপর চরম অপমানজনক ঘটনা কেউ ঘটায়, তখনও যেন সস্নেহ প্রশ্রয়ে নির্লজ্জ পুরুষ দোষারোপ করে নারীর পোশাক বা রাতে তাদের বাইরে বেরনোকে।
ঢক্কানিনাদ উঠেছে চারদিকে দেশ, সমাজ নাকি উল্কার বেগে এগিয়ে চলেছে। ভাবতে তো ভালোই লাগে। কিন্তু বাস্তবে কী দেখা যাচ্ছে? এখনও পুরুষই বলে দিচ্ছে একজন নারীর সন্তান ক’টি হবে। না, দাম্পত্য জীবনের গল্প নয়, রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিরা অসীম দুঃসাহসে এখন সবকিছু বলে দিতে পারেন। এরপর তাঁরাই ঠিক করে দেবেন একজন নারীর জন্য ঠিক কতটা অক্সিজেন বরাদ্দ হওয়া উচিত। কতটা খাদ্য তার জন্য সঠিক, এমন আরও অনেক কিছু। নারী বস হলে সমস্যা দেখা দেবে, এমন অকুতোভয় আবেদন যাঁরা ন্যায়ালয়ে পেশ করার হিম্মত রাখে, তারা ভবিষ্যতে আরও কী কী বিষয় নিয়ে নারীদের বিরুদ্ধে সরব হতে পারেন, তা কল্পনারও বাইরে।