ঘটা করে নারীদিবস পালন হ’ল। কত নাটক হ’ল। রাজনীতিও হ’ল। কিন্তু সম্মান? লিখছেন সফিউন্নিসা
(পর্ব-২)
নারী প্রগতির নতুন দিশা
না, শুধু নারীরাই নন, সাহসী পুরুষের সংখ্যাও যে দিনে দিনে বাড়ছে, তা সাম্প্রতিক একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নির্দ্ধিধায় বলে দেওয়া যায়। চারদিকে যখন অশিক্ষার চাষ বাড়ছে, যুক্তিহীন কথাবার্তার ফুলঝুরি ছুটছে, সর্বোপরি প্রতিবাদ করা বা ভুল শুধরে দেওয়াকে যেখানে ক্ষমাহীন ঔদ্ধত্য মনে করে চরম দণ্ড বিধান করা হচ্ছে, সেখানে কিছু নারীপুরুষের কুকুরযোনি, গো-যোনিতে জন্মগ্রহণের ভয়কে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া বড় কম কথা নয়।
এই একবিংশ শতকে হাম দো হামারা দো-র যুগে স্বামী-স্ত্রীর সংসারে সব পরিবারে রাধুঁনিও থাকে না যে, কর্ত্রীর ঋতুকালীন অবস্থায় তাঁকে রান্নার দায়িত্ব দিয়ে পরজন্মে স্বামী নিজের বলদ হয়ে জন্মানো আটকাবেন। মহিলাটির অবস্থা আরও করুণ। সে বেচারি শুধু শুধু কুকুর হয়ে জন্মাবে পরিবারের সেবা করতে গিয়ে। স্বামী-সন্তানের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার এমন শাস্তি? হ্যাঁ, সেইরকমই বিধান বটে জনৈক ধর্মগুরুর। তিনি নারীযোনি সম্ভূত কিনা এ সব আদ্যিকেলে প্রশ্ন অবশ্য কোনও নারী তোলেননি। তাঁরা হাতেকলমে কিছু শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন।
‘গুরুজি’র মহাবচন উচ্চারিত হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই দিল্লির একটি এনজিও দারুণ তৎপরতার সঙ্গে রজঃস্বলা আঠাশজন নারীকে রান্নায় নামিয়ে দেয়। তাদের প্রত্যেকের অঙ্গে সাদা অ্যাপ্রন, তার পিঠে স্পষ্টভাষায় ঘোষণা ছিল যে, তাঁরা নারীত্বের স্বাভাবিক ও অবধারিত ওই শারীরিক অবস্থার মধ্যে রয়েছেন। সম্ভবত তাঁরা গুরুজির মাতৃদেবীর জন্য ব্যথিত হচ্ছিলেন, তাঁর মতো সন্তানের জন্ম দেওয়ার দুর্ভাগ্যের জন্য।
যাই হোক ওই আঠাশ নারী দিল্লির রাস্তার পাশে প্রকাশ্যে চর্ব্যচোষ্যর বিরাট আয়োজন করে ব্যাপক সাড়া পেলেন। দলে দলে ‘মানুষ’ এসে তৃপ্তিসহকারে ভোজন সারলেন। তিনশোরও বেশি খাদ্যরসিকের মধ্যে দিল্লির উপ-মুখ্যমন্ত্রীও ছিলেন।
বোঝা গেল, অনেক নারী-পুরুষই কিছু অলীক ভয় কাটিয়ে উঠতে দ্বিধা করেন না। কিন্তু এ তো সিন্ধুতে বিন্দু। আজও মহিলাদের নিয়ে যে কত কুসংস্কার, তার কোনও ইয়ত্তা নেই। বিশেষ করে তার পবিত্রতা-অপবিত্রতা নিয়ে। বিপদের দিক হল এটাই যে, নারীর ওপর আরোপিত অসংখ্য অপমান নারীরাই নিষ্ঠার সঙ্গে লালন করে চলেছেন যুগ যুগ ধরে। কোথাও ধর্মীয় বিধান ভেবে, কোথাও পরিবারের অকল্যাণের অলীক আতঙ্কে। আজ একবিংশ শতকের নারীকে যখন বিভিন্ন ধর্মীয় স্থানে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়, নারী তা নত মস্তকে মেনে নেয়। যাঁরা মনের জোর দেখিয়ে বাধা অতিক্রম করতে গিয়েছেন, তাঁরা লাঞ্ছিত হয়েছেন পরিবারের নারীদের হাতেই। এমনকী প্রহৃতও হয়েছেন, তাঁদের সংসার ধ্বংস হয়েছে, সন্তানকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ঘটা করে নারীদিবস পালন হ’ল। কত নাটক হ’ল। রাজনীতিও হ’ল। কিন্তু সম্মান? সারা দেশ জুড়ে নারীহত্যা, ধর্ষণ, নারীদেহ ব্যবসার রমরমা বাজার। ক্ষমতাসীন প্রভুদের অনেকেই যে কোনও নারীশরীরকে চানাচুর চিপসের বেশি মূল্য দিতে রাজি নয়। নারীর আবার প্রতিবাদ? সেই স্পর্ধা দেখাতে গিয়ে সপরিবারে খুন হওয়ার ঘটনাও প্রকাশ্যে এসেছে। এমনকী তাঁর হয়ে লড়তে চাওয়া আইনজীবীকেও যমের দুয়ারে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে কালবিলম্ব না করে।
লড়াকু কোনও নারী আলো দেখাবে নারীকে? প্রতিবাদের ভাষা শেখাবে? গৌরী লঙ্কেশকে ‘শিক্ষা’ দিয়ে গোটা নারীকুলকে সতর্কবার্তা দেওয়া হ’ল। আসলে পুরুষতন্ত্র চায় নারীর মস্তিষ্কহীন শরীর। সে যত চেতনাহীন হবে, ততই আজ্ঞাবাহী হবে। সর্বত্র এই এক প্রয়াস আদিযুগ থেকে। মাতৃত্বে নারীকে মহিমান্বিত করা হয়েছে সবসময়। কেউ বলতে পারেনি ‘ওহে স্বার্থপর, দাম্ভিকের দল এই ছলনা চলবে আর কতদিন?’
অতি সম্প্রতি চমকে দেওয়ার মতো একটি সরকারি নির্দেশিকায় বলা হয়েছে শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগে প্রার্থীদের শারীরিক সক্ষমতার পরীক্ষাও নেওয়া হবে। হতেই পারে। এতে আপত্তির কিছু নেই। সুস্থ শিক্ষাদাতা না হলে পড়ুয়ারা সুস্থতার পাঠ নেবে কী করে। চমকটা এখানেই যে শিক্ষিকাদের অন্যান্য সব পরীক্ষার সঙ্গে তাদের জরায়ুর সুস্থতার প্রমাণও দিতে হবে। মেয়েদের অন্যান্য শারীরিক দিকগুলির সঙ্গে এই বিষয়টি জুড়ে দেওয়ার মহৎ পরিকল্পনা কার মস্তিষ্কপ্রসূত জানতে ইচ্ছে করে। উচ্চশিক্ষিত মেয়েদের ক্ষেত্রেও এই বিধানের কথা যিনি বা যাঁরা ভেবেছেন তাঁদের বিরুদ্ধে আদালতের দ্বারস্থ হওয়া উচিত মেয়েদের। মানসিক বিকৃতি আর মেয়েদের অপমান করার স্পর্ধা না হলে বাড়তে বাড়তে কোথায় পৌঁছে যাবে কে জানে?