চিলের নারীবাদী সংগঠন ‘লাস তেসিস’-এর ডাকে সে দেশের সরকার বিরোধী আন্দোলনের পাশে দাঁড়িয়ে ধর্ষণ তথা পুরুষতান্ত্রিক হিংসার বিরুদ্ধে আঙুল তুলেছিলেন সেখানকার মহিলারা। দিনটি ছিল ২০১৯-এর ২০ নভেম্ভর। কবিতার এই দেশ থেকে ওই গর্জন ছড়িয়ে পড়ে সান্তিয়াগো, মেক্সিকো, আর্জেন্তিনা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, লন্ডন, প্যারিস, জার্মানি-সহ নানা জায়গায়। তার ঢেউ এসে লাগে এ দেশেও। দিল্লি এবং চেন্নাইয়ের পরে এই আন্দোলন এসে পৌঁছোয় কলকাতায়। নিউ মার্কেটের কাছে গত ৪ জানুয়ারি ধর্ষক মানসিকতার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন শ’দুয়েক মহিলা। সেই কর্মর্সসূচির নাম ছিল ‘নারীবাদী হাঙ্গামা’। এই প্রেক্ষাপটে লিখছেন সফিউন্নিসা।
২৮ থেকে ৮০
(পর্ব-১)
এটা রাজনীতির কোনও সংখ্যাতত্ত্বের হিসেব নয়। আমাদের অতি সুসভ্য সমাজে নারী নির্যাতনের মুখপাত। দিনের হিসেব থেকে বছরের অঙ্কের এক ক্লেদাক্ত পরিধি।
বাকসর্বস্বতা থেকে কুকার্যসর্বস্ততার ক্রমসহনীয় এক নারকীয় বাস্তবের একটুখানি আভাস। অবশ্য একইসঙ্গে ভাবার বিষয, নারী-সুরক্ষা, নারীসম্মান কি কোনও যুগে কোনও কালে আদৌ ছিল? ছিল না। তবে শাস্তির ভয় ছিল। সমাজের সম্মিলিত প্রতিবাদের ভয় ছিল। অবশ্যই তা যুদ্ধ বা দাঙ্গা ব্যতিরেকে। ওই দু’টি ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ অসহায় শুধু নয়, উপায়হীন। পৃথিবীতে মানবসভ্যতা যেদিন থেকে পুরুষশাসিত চেহারা পেয়েছে, সেদিন থেকেই নারী অবমাননার সূত্রপাত ঘটে গিয়েছে।
বিজিত পুরুষের ক্ষমতার দম্ভে পদাঘাত করার সহজ উপায় তার ভালোবাসা বা ভোগের উপকরণ নারীকে দখল করা, তার ওপর বলাত্কার করা বা তাকে ছিন্নভিন্ন করে ভোগ করার পরে হত্যা করে বিজেতার অহং পরিতৃপ্তির বহু ঘটনার সাক্ষ্য বহন করছে ইতিহাস। এথনিক, ক্লিনজিং-এর ভয়াবহ আগ্নেয়স্রোতেও দুষ্কৃতীরা নারীশরীর খুঁটে নিতে ভুল করে না। এগুলিকে ‘গণ’ আখ্যা দিয়ে সভ্যসমাজ আলোচনার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে জাত-ধর্মের হিসেবের দিকে। একবার নয়, বার বার। বেশ কয়েক বছর ধরে ‘গণ’ শব্দটি ভিন্নতর অর্থ পেয়েছে। এখন তা টুকরো টুকরো হয়ে ঢুকে পড়েছে সমাজের অলিতে-গলিতে, সাধারণ খেটে খাওযা মানুষের ঘরেও। আতঙ্কের বাতাবরণ তৈরি করে ফেলেছে বেশ দ্রুত সমাজের প্রায় সর্বস্তরেই।
প্রথমদিকে মানুষের ক্রোধ, ঘৃণাকে খুব সুকৌশলে চালিত করার চেষ্টা হ’ল বিশেষ কিছু শ্রেণির মানুষের দিকে, যারা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল আর অশিক্ষিত। ঠিক যেমন হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে আদিবাসী সম্প্রদায়কে অপরাধীর তকমা সেঁটে দিয়ে। এই আত্মছলনা বেশিদিন টিঁকল না। ২০১৯-এর বর্ষবরণের রাতে নারীপুরুষের ভিন্ন চলার রাস্তার ব্যারিকেড ভেঙে যেভাবে একদল মত্ত পুরুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে মেয়েদের গণ-শ্লীলতাহানি করল, এরা কেউ দুর্বল শ্রেণির ‘অশিক্ষিত’দের দলে পড়ে না। ২০১৭ সালেও এই একই ঘটনা ঘটে। তাই এ বার মেয়েদের ‘রক্ষা করার জন্য পুলিশি বুদ্ধি প্রযোগ করে এমন নিশ্ছিদ্র’ ব্যবস্থা করা হয়েছিল, যা সহজে ভেঙে মত্ত বীরপুঙ্গবরা তাদের বীরত্ব দেখাতে দারুণভাবে সক্ষম হ’ল। এরপরেও এ নিয়ে কোনও সামাজিক আন্দোলন হ’ল না। সুশীল সমাজকে ধিক্কার বা প্রতিবাদে সামিল হতেও দেখা গেল না। অবশ্য এইসমযে প্রতিবাদ করার অর্থ নিজের বিপদ ডেকে আনা। সিসি ক্যামেরার জুজু আস্ত দানব হয়ে ঘাড় মটকানোর জন্য সদা তত্পর শুধুমাত্র বিবেকবান মানুষের জন্য। গণহত্যা, গণধর্ষণকারীদের জন্য গাঁদাফুলের মালার আয়োজন সুনিশ্চিত রাখতে সিসি ক্যামেরার অটোসিস্টেম কী ভদ্রভাবেই না চোখ বুঁজে থাকে !
মনে পড়ে কয়েকদশক আগে এক বিনোদন জলসায় লেক সরোবর এলাকায় হঠাত্ আলো চলে যাওয়ার সুযোগে কী ঘটেছিল? সেই গণধর্ষণের ন্যক্কারজনক ঘটনায় অপরাধীদের নাকি খুঁজেই পাওয়া যায়নি। মনে পড়ে বানতলার ঘটনা? দুই মহিলা সরকারি আধিকারিক আর তাঁদের ড্রাইভারকে দিনের আলোয় হাজার হাজার লোকের সামনে ছেলেধরা জিগির তুলে হত্যার ঘটনার কথা? তার আগে দুই মহিলাকে চরম শ্লীলতাহানির দৃশ্য জনতার গণপর্নগ্রাফিক মানসিকতায় তাড়িয়ে তাড়িয়ে লেহন করার কথা? মনে পড়ে বিরাটির ঝুপড়িবাসিনী দরিদ্র অসহায় মহিলার কথা, যাঁকে গণধর্ষণ করার পর কিছু প্রতিবাদী কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য মহিলাটির চরিত্র ভালো নয়, এমন ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছিল শাসকের তরফ থেকে। দশকের পর দশক পেরিযে যায়। ঘটনাগুলি বিরোধী রাজনৈতিক দলকে অক্সিজেন জোগায়। তাদের ক্ষমতায় আসার সিঁড়িটাকে আরও অনেকখানি মজবুত করে। আর এইসব নারীরা অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছিল। ঘটনাপ্রবাহ চলতেই থাকে। স্থান-কাল বদলায়। বানতলা, বিরাটি উঠে আসে পার্কস্ট্রিটে। সংবাদপত্রের হেডিংটা শুধু একটুখানি পালটায়। বানতলা-বিরাটির জায়গায় কম্পোজ করা হয় পার্কস্ট্রিট-কামদুনি-মধ্যমগ্রাম। বিরোধীদল আবার নতুন করে অক্সিজেনের জোগান পায়। লাঠিসোটা-মোমবাতি-ঝান্ডাধারীদের পোয়াবারে। ধুলোবালি ঝেড়ে কী আদরে তাদের নিয়ে পথে নামে রাজনীতির কারবারিরা!
আমরা, এই আমজনতা কী বেহায়া। অসহায়তা নিয়ে আবার আশায় বুক বাঁধি। আবার সুদিন আসবে! এদের মতো এত জোরে আওয়াজ তুলে প্রতিশ্রুতি আগে আর কেউ দেয়নি। আস্তে আস্তে আমাদের মস্তিষ্ককে আরও বেশি চাতুর্যে ওরা অবশ করে দিতে থাকে। নারীনির্যাতন, নারীঅবমাননাকে চরম অপরাধ হিসেবে গণ্য না করে জাতপাতের অঙ্কে ব্যাখ্যা করে আমাদের চোখ, কান, বোধ-বুদ্ধি-বিবেচনাকে কেমন ভুল পথে চালনা করে তার ফায়দা তোলার খেলা শুরু হযে যায়। আমরা সবাই ওদের ঘৃণার রাজনীতির শিকার হযে যাই। কেউ রোষের, কেউ ছদ্মপ্রেমের। আমজনতার মধ্যে বিভেদ যত বাড়ে, তারা যতবেশি নিজেদের মধ্যে খোয়োখেয়িতে উন্মত্ত উন্মত্ত হয়ে ওঠে, ততই দলের টিআরপি বাড়ে। আগুনে হাওয়া দেওয়া দলের নেতাদের মুখের হাসি আরও চওড়া হয়।
তা হলে শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াল? কিচ্ছুই দাঁড়াল না। দাঁড়াবেও না। কেন না দাঁড়িয়ে যাওয়া মানেই তো স্থিতাবস্থা। তার মানেই তো থেমে যাওয়া। তার মানে মৃত্যু। কী নিয়ে তা হলে রাজনীতি হবে? ক্ষমতা দখলের প্রক্রিয়া বজায রাখতে হলে আমজনতাকে এমন শান্ত করে দিলে তারা এ বার দাবি তুলবে অন্ন-বস্ত্র-আবাস-শিক্ষা। তারপরে তো আরও বিপজ্জনক চাহিদা ব্যক্তিস্বাধীনতা, কর্মসংস্থান, বাকস্বাধীনতা–এমন সব হাজারো ‘ফালতু’ জিনিস যা ব্যতিব্যস্তই শুধু করবে না, তাদের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেবে। সুতরাং রেপটাকে হাতের মূল অস্ত্র রেখে তুলে নেওয়া হ’ল গোরুচুরি, ছেলেচুরি আর গণপিটুনির সংস্কৃতি। মেয়ে আবার মানুষ নাকি, তাদের বিরুদ্ধে কথা বলা মানে নিজেদের ডিগনিটি নষ্ট করা।
তবু বিবৃতি দিতে হয় তুচ্ছদের সম্পর্কেও। তখনই বেরিয়ে পড়ে ভেতরের দানব। কেউ বলে রেপটা মেয়েরাও এনজয় করে, কারও মতে ছোট পোশাক পরে ওরাই ধোয়া তুলসীপাতাদের উত্তেজিত করে, কেউ কেউ অত্যন্ত সংযমের পরিচয় দিয়ে বলার কথাটা না বলে রেপিস্ট-শিশুদের পাশে পরম মমতায় দাঁড়িয়ে যায়। বলার কথাটা তাদের আচরণে প্রকট হয়, ‘ভোগের সামগ্রীকে ভোগ করা হয়েছে। তাতে এত কথা কিসের। মেয়েমানুষ লজ্জায় কোথায় মুখ লুকোবে, তা না করে আবার প্রতিবাদ!’ কী দুঃসাহস! আবার মামলা-মোকদ্দমা? উচিত সাজা কী করে দিতে হয়, তা গোপনে নয়। অন্যদের সামনে উদাহরণ হিসেবে তুলে সবাইকে সমঝে দেওয়ার জন্য চোদ্দপুরুষকে নিকেশ করে দাও। বিরোধী দলের মদতেই না এমন দুঃসাহস! দ্যাখ, তার ফলটা। প্রথমে পরিবার, তারপরে লড়াই চালাতে আসা আইনজীবী, তারপরে বীরাঙ্গনাটিকে উচিত শিক্ষা দেওযা হল। কোনও নারীর আর সাহস হবে এরপর সমাজের বিরুদ্ধে, পুরুষের বিরুদ্ধে মুখ খোলার?
হ্যাঁ, ২৮ দিনের থেকে ৮০ বছর সব ভোগ্য। তাদের শরীরের পোশাক প্রসঙ্গ তুলে আর ভুল করা নয়। নারীশরীর চাই মদের সঙ্গে চাটের মতো। যা পাওযা যায় হাতের কাছে বা পরিকল্পনা মাফিক।