ট্রাফিক সিগন্যালে নয়, একে বারে আন্তর্জাতিক মঞ্চে কবিগুরুকে তুলে ধরে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে টেক্কা দিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। রোম সফরে যেতে পারলেন না তৃণমূলনেত্রী। ‘হিংসা’ থেকেই মমতাকে রোমে শান্তি ও সামাজিক ন্যায় সংক্রান্ত বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যেতে ভারত সরকারের বিদেশ মন্ত্রক বাধা দিল। এমনটাই দাবি মমতার। আর ভারত সরকারের বিদেশ মন্ত্রকের বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রীর মর্যাদা এবং রাজনৈতিক দিক থেকে আমন্ত্রণটি উপযুক্ত না হওয়ায় তারা সফরের ছাড়পত্র দিচ্ছে না। রোম সম্মেলনে যোগ দিতে পারলে সেখানকার মঞ্চ থেকে মমতা নিশ্চয়ই শান্তি আর সহিষ্ণুতার বার্তা দিতেন। সেই মাইল স্টোন ছুঁতে দেওয়া হল না বলে বিজেপি ও তৃণমূলের দ্বৈরথ মাত্রা পেয়েছে। তার মধ্যে প্রাসঙ্গিত হয়ে উঠেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
কলকাতা শহরের রাস্তার মোড়ে মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যালে রবীন্দ্র সংগীত বাজানো হয়। ২০১১ সালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর রাস্তার মোড়ে মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যালে রবীন্দ্র সংগীত বাজানো চালু করেন। বাঙালির সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে মমতার এই প্রচেষ্টা স্থান-কালের সঙ্গে কতটা মানানসই, তা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। চুলোয় যাক সে সব। রেলযাত্রার একঘেয়েমি কাটাতে লোকাল ট্রেনের সব কামরায় রবীন্দ্র সংগীত বাজাতে চাইছে পূর্ব রেল দফতর। তার পরীক্ষা-নিরীক্ষাও শুরু হয়েছে। এ নিয়ে রাজ্যের শাসকদলের এক মন্ত্রীর দাবি–সবটাই ভোটের জন্য। কেন্দ্র বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে নকল করছে। যা মানুষ ধরে ফেলছে। এতে তৃণমূলনেত্রীর নম্বর বাড়ছে। আর বিজেপি নেতাদের পালটা যুক্তি–তৃণমূল কংগ্রেস নেতারা সবকিছুর মধ্যেই রাজনীতি দেখেন। কেন্দ্রের একাধিক জনমুখী প্রকল্প তৃণমূল সরকার নিজেদের বলে চালাচ্ছে। রাজ্যবাসী তা বোঝেন। এই চাপান-উতোরের মধ্যে কবিগুরুকে হাতছাড়া করতে চাইছে মা মোদী-সরকার। তাই এ বার কবিগুরুকে একেবারে আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিয়ে এলেন নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী। রোমে গিয়ে মমতাও হয় তো রবীন্দ্রনাথকে টেনে আনতেন। তুলে ধরতে পারতেন কবিগুরুর বিশ্বশান্তির বাণী, সহিষ্ণুতার আহ্বান। মমতার এ জন্য আক্ষেপ হতেই পারে। কারণ, রাষ্ট্রপুঞ্জের মঞ্চে কবিগুরুর বাণী আওড়েছেন মোদী। রবীন্দ্রনাথের কথা উল্লেখ করে মোদী বলেছেন, ‘‘শুভ কর্মপথে, ধরো নির্ভয় গান। সব দুর্বল সংশয় হোক অবসান।’’ এ কথা রাষ্ট্রপুঞ্জ এবং প্রতিটি দায়িত্বশীল দেশের পক্ষে খাটে বলে মোদী দাবি করেছেন।
শনিবার রাষ্ট্রপুঞ্জের ৭৬তম সাধারণ সভায় মোদী জলবায়ু পরিবর্তন, কোভিড পরিস্থিতি, ছায়াযুদ্ধ এবং সন্ত্রাসবাদ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপুঞ্জের ভূমিকার কথা স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি বলেন, ‘‘রাষ্ট্রপুঞ্জের কার্যকারিতা বাড়াতে হবে।’’ এ দিন রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভার অধিবেশনে নিজের বক্তব্যের শেষে কবিগুরুর শরণ নেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। রাষ্ট্রপুঞ্জের ভূমিকার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি কবিগুরুর বাণী তুলে ধরেন। এই প্রথম নয়, এর আগে বহু বার রবীন্দ্রনাথের কবিতার পঙ্ক্তি উঠে এসেছে মোদীর গলায়। ২১শের বিধানসভা নির্বাচনের ভোটপ্রচারে পশ্চিমবঙ্গে এসে বেশ কয়েকবার রবীন্দ্রনাথের কবিতাকে সামনে রেখে রাজ্যবাসীকে বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ‘সোনার বাংলা’ গড়তে চেয়ে তিনি কবিগুরুতেই ভর করেন। কিন্তু তাঁর প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। তাই বলে তিনি যে কবিগুরুকে ভুলে যাননি, বাংলা তথা বাঙালির মন পেতে তা শনিবার আন্তর্জাতিক মঞ্চ থেকে বুঝিয়ে দিলেন।
অন্যভাবে বলতে গেলে আন্তর্জাতিক দরবারে কবিগুরুকে তুলে ধরার সুযোগকে হাতছাড়া করতে চাইলেন না ভারতের প্রধানমন্ত্রী। তা হলে সঙ্ঘপরিবার কি মোদীকে বুঝিয়েছে, বাঙালির মন পেতে পদে পদে কবিগুরুর শরণ নিতে হবে? আসলে ভোট যে বড় বালাই! কমিউনিস্টরাও এক সময়ে রবীন্দ্রনাথকে সহ্য-ই করতে পারতেন না। পরে অবশ্য তাঁরা মত বদলেছেন। তাই দেরিতে হলেও কমিউনিস্টদের কাছে কবিগুরু এখন আর অচুছুৎ নন। তাই মোদীও কবিগুরুতেই ভর করে সব দুর্বলতার অবসান চাইছেন।