কলকাতা বন্দরের নাম বদল ও রাজনীতি

শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং কলকাতা বন্দর। ছবি–সংগৃহীত

কলকাতা বন্দরের নাম বদলে সায় দিয়েছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা। তা নিয়ে নতুন করে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার কলকাতা বন্দর শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নামে চিহ্নিত হবে বলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গত ১২ জানুয়ারি কলকাতা বন্দরের ১৫০ বছর পূর্তির অনুষ্ঠানে এসে জানিয়েছিলেন। তাতেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা সিলমোহর দিল।

কলকাতা বন্দরের অধীনে নেতাজির নামে সুভাষ ডক অনেকদিন ধরেই আছে। নয়া সিদ্ধান্তের ফলে গোটা বন্দর এখন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নামেই চিহ্নিত হল। ফরওয়ার্ড ব্লক থেকে বলা হয়েছে, মন্ত্রিসভার এই সিদ্ধান্তে নেতাজিকে অপমান করা হল। বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবারের ‘আদর্শ গুরু’, হিন্দু মহাসভার নেতা, ভারতীয় জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদের নামে কলকাতা বন্দরের নামকরণ নিয়ে রাজ্যের রাজনৈতিক দলগুলি আগেই আপত্তি তুলেছিল। বাম পরিষদীয় নেতা সুজন চক্রবর্তীর অভিযোগ, ‘‘বিজেপি সরকার যেখানে যেমন খুশি নাম বদলাচ্ছে। সেইমতো কলকাতা বন্দরে নেতাজির উপরে চাপিয়ে দেওয়া হল শ্যামাপ্রসাদের নাম।’’ আর বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ কেন্দ্রের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘শ্যামাপ্রসাদ পশ্চিমবঙ্গের জনক। স্বাধীন ভারতের প্রথম রাজনৈতিক শহিদ। দেশের অখণ্ডতা ও সংহতির জন্য তিনি প্রাণ বলি দেন।’’ তাই তিনি কলকাতা বন্দরের নাম শ্যামাপ্রসাদের নামে রাখার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে অজস্র ধন্যবাদ জানিয়েছেন। এ নিয়ে নতুন বিতর্ক দানা বেঁধেছে। অনেকেরই প্রশ্ন কে বেশি মহান–নেতাজি, না শ্যামাপ্রসাদ! সুজন চক্রবর্তীর সাফ কথা, ‘‘প্রথমজন বিপ্লবী, আর দ্বিতীয়জন ঔপনিবেশিক শাসকের সহায়ক, বাংলা ভাগের উদগাতা।’’ কাজেই কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া যায় না বলেই তাঁর মত। আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে ভারতীয় যুবকদের অন্তর্ভুক্তিতে সাহায্য করা বা মুসলিম লিগের সঙ্গে বাংলায় মন্ত্রিসভা গঠনের প্রসঙ্গ তুলে শ্যামাপ্রসাদের  নামে বন্দরের নামকরণের তীব্র বিরোধিতা  করেছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্র।

যদিও, মোদী সরকারের যুক্তি, বাংলার মানুষের আবেগের কথা মাথায় রেখেই কলকাতা বন্দরের নাম বদলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারছেন না রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর মতে, ‘‘কলকাতা বন্দরের নাম পরিবর্তন না হলেই ভাল হত।’’ অবশ্য দেশে জাতীয় নেতাদের নামে অনেক বন্দর বা বিমানবন্দর রয়েছে। যেমন, মুম্বই বন্দরের নাম জওহরলাল নেহরুর নামে, তুতিকোরিন বন্দরের নাম ভি ও চিদম্বরানারের নামে, এন্নোরের নাম কামরাজ ও কাণ্ডলা বন্দরের নাম দীনদয়াল উপাধ্যায়ের নামে নামাঙ্কিত হয়েছে। কিন্তু গোল বেধেছে নেতাজির নামের ওপর শ্যামাপ্রসাদের নাম চাপিয়ে দেওয়ায়। তা কতটা যুক্তিসঙ্গত, তা নিয়ে ইতিহাসবিদ রজতকান্ত রায়ের মত, ‘‘সুভাষ ও শ্যামাপ্রসাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ স্পষ্ট আলাদা ছিল। আর কলকাতা বন্দরের নাম  যাঁর নামেই রাখা হোক, তার মধ্যে রাজনীতি নিহিত।’’ এ নিয়ে চর্চা যে চলবে, তা বলাই বাহুল্য। ফরওয়ার্ড ব্লক নেতৃত্ব তো চিঠি দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে জানিয়ে দিয়েছে, নেতাজিকে ‘অপমান’ কোনও মতেই বরদাস্ত করা হবে না। প্রয়োজনে তাঁরা আন্দোলনে নামতেও পিছপা হবেন না। নেতাজিকে আঁকড়ে ধরেই তাঁরা যেমন রাজনীতি করতে চান, বিজেপি নেতৃত্বও একইভাবে শ্যামাপ্রসাদকে সামনে রেখে বাংলা দখল করতে মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন। বসে নেই তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো। তিনি কলকাতা বন্দরের নাম বদল নিয়ে নরম সুরে কথা বললেও আগামী বিধানসভার ভোটকেই পাখির চোখ করে ঘর ঘোছাতে শুরু করেছেন। তাতে কে জিতবে, আবেগ না রাজনীতি, তা সময়ই বলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here